মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় মদকে মাদকদ্রব্য শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী ‘মাদকদ্রব্য’ শ্রেণিতে মদের অন্তর্ভুক্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছে।
এই আইনে মদকে ‘মাদকদ্রব্য’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দায়ের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (১৩ ডিসেম্বর) বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলিরুজামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।
আগামী ৪ সপ্তাহের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই রুলের ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন আদালত। সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের শরীয়তনগরের আরজে টাওয়ার হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফারুকের মদকে মাদকদ্রব্যের বাইরে রাখতে সরকারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে এই রিট আবেদনটি করেন।
রিট আবেদনকারীর ভাষ্য, মদকে অন্যান্য মাদক দ্রব্যের সঙ্গে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। ফলে নিষিদ্ধ মাদকের মধ্যে মদ বা অ্যালকোহলকে রাখা হয়েছে। কিন্তু অ্যালকোহল আমদানি-রপ্তানিযোগ্য পণ্য। এটা মাদকদ্রব্যের শ্রেণির মধ্যে পড়ে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি মাদকদ্রব্যের শ্রেণিভুক্ত নয়। এটার কার্যক্রম এবং প্রয়োজনীয়তা মাদকের যে সংজ্ঞা তার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
পানযোগ্য অ্যালকোহল এবং নিষিদ্ধ মাদককে একই শ্রেণিভুক্ত করায় যারা অ্যালকোহল বিক্রি করেন তাদের ব্যবসা করতে ও এটি আমদানি-রপ্তানিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। আবেদনকারীরা আরও বলেন, মাদকদ্রব্যের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির কারণে মদের ব্যবসা করতে তারা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যালকোহলের উৎপাদন, বিক্রয়ের জন্য লাইসেন্স দেওয়ার বিধান রয়েছে। যেগুলো অন্য কোনো মাদকের ক্ষেত্রে নেই। অ্যালকোহল নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। লাইসেন্স নিয়ে অ্যালকোহল ক্রয় বিক্রয় করা যায়। এখন যেটি অনুমোদন নিয়ে সরবরাহ ও বিক্রি করা যায় সেটি কেন নিষিদ্ধ মাদকের শ্রেণিভুক্ত হবে এটাই ছিল রিট আবেদনকারীর আইনজীবীদের বক্তব্য। আদালত শুনানি নিয়ে রুল দিয়েছে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত বলেন, ‘পিটিশনারের আইনজীবীর বক্তব্য শুনে আদালত রুল দিয়েছেন। মদকে কেন মাদকদ্রব্যের শ্রেণিভুক্ত সেটি বিবাদীদের কাছে জানতে চেয়েছে আদালত।’
উল্লেখ্য, আদালতের আবেদনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন আহসানুল করিম। আর রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত।
বছরে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু
বিশ্বব্যাপী মদ সেবনের ক্ষতিকর প্রভাবে বছরে মারা যায় ত্রিশ লাখ মানুষ। এর ক্ষতিকর প্রভাবে দুশো ধরনের রোগ ও ইনজুরিতে আক্রান্ত হয় মানুষ। ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী যারা মারা যায় তাদের মধ্যে সাড়ে ১৩ ভাগই মদ্যপানজনিত কারণে মারা যায়। মদ সেবনের প্রতিক্রিয়ায় মানসিক ও আচরণগত সমস্যা দেখা দেয় অনেকের মধ্যে।
এদিকে, বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন মদ পান করে। অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস মদ্যপান। প্রতিবছর ২৮ থেকে ৩০ লাখ মানুষ মারা যায় মদের কারণে। এসব তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্য এতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
করোনা মহামারিতে বেড়েছে এ মৃত্যুহার। লকডাউনে মানুষের জীবন-যাপনেও এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। তবে করোনায় লকডাউনের সময় একঘেয়েমি ভাব দূর করতে অতিরিক্ত মদ পান করে বসেন অনেকে। এতেই বেঁধেছে বিপত্তি। নতুন এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে ৫ হাজার ৪৬০ জন মৃত্যু হয়েছে। যা ২০১৯ সালের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বাংলাদেশে মদ সেবনের কারণে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালেই মারা গেছে দু’হাজারেরও বেশি মানুষ। এছাড়া ক্যান্সার ও মদ্যপানের পর ড্রাইভিংয়ের সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে আরও অন্তত এক হাজার মানুষের। সব মিলিয়ে ওই বছর মদ্যপান জনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি।
সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মদ বিক্রি ও সেবনের বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তবে ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ মদ বিক্রি কিংবা সেবনের বিরুদ্ধে তারা তাদের সাধ্যমত ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ