বাংলাদেশে মাঝে-মধ্যেই পোশাকের কারণে নারীদের বিব্রত হবার ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীকে উল্টো তার পোশাকের জন্য দায়ী করার প্রবণতাও দেখা যায়। সম্প্রতি কপালে টিপ পরা নিয়ে এক পুলিশ সদস্য একজন শিক্ষিকাকে হেনস্থা করার অভিযোগ নিয়েও তুমুল শোরগোল হয়েছিলো। এরপর ঢাকা যাওয়ার পথে আধুনিক পোশাক পরায় এক তরুণীকে হয়রানি ও মারধরের ঘটনায় গোটাদেশে তোলপাড় ঘটে গিয়েছিল।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী গত ১৮ মে ভোরে নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে গালিগালাজ ও মারধরের শিকার হন। তার সঙ্গে থাকা দুই বন্ধুও মারধরের শিকার হন। এক ব্যক্তি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুরো দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্তার এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পক্ষ থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করা হয়।
তরুণীকে হেনস্তার প্রসঙ্গ নিয়ে হাইকোর্ট প্রশ্ন রেখেছেন, সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না। আদালত বলেছেন, ‘(ওই তরুণী) প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?’
পোশকের জন্য নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তার অভিযোগে করা মামলায় এক আসামির জামিন আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট এ প্রশ্ন রাখেন। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে মঙ্গলবার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানি নিয়ে আদালত মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলাকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন।
এর আগে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ঘটনাটির সূত্রপাত করেছিলেন শিলা। তিনি বলেছিলেন, এ রকম পোশাক পরেছ? এরপর লোকজন ডাকেন শিলা। পোশাক নিয়ে অশালীন মন্তব্যসহ তরুণী ও তার বন্ধুদের শার্টের কলার ধরে টানাহেঁচড়া করে মাফ চাইতে বলেন শিলা।
শুনানির একপর্যায়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দা জাহিদা সুলতানা বলেন, কী পোশাক পরবে, সে বিষয়ে ব্যক্তির অধিকার আছে। তাই বলে এ জন্য অপমান ও হেনস্তা করতে পারে না।
তখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার আছে কি না? পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। ঢাকায় এক ধরনের, গ্রামে অন্য ধরনের।’ তখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।
আদালত বলেছেন, ‘(ওই তরুণী) প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?’
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের একটা বড় জায়গা ছিল ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেই লড়াইয়ে নারীদের বড় অংশগ্রহণ ছিল। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। তারপরে কেটে গেছে ৫০টিরও বেশি বছর। ঘটেছে বহু নীরব ও সরব নারীবাদী আন্দোলন।
আজ নারী সমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এক পৃথিবীতে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছেছে মানুষ। বিশ্বায়নের স্রোতে আজ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও আধুনিক সভ্যতার অংশ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভালো নেই বাংলাদেশের নারী। আধুনিক পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে তারা শ্বাস নিতে পারছেন না।
ধর্ষণ, নিপীড়নের পাশাপাশি এক নতুন উপদ্রব নারীর সাজ ও পোশাক নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি ক্ষমতায়। দেশের অব কাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক।
নারীরা আজ রাজনীতি ও প্রশাসনের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন এবং সেই ক্ষেত্রে সরকারের একটা প্রচেষ্টাও আছে। কিন্তু সরকারি এসব কাজ যে সার্বিক নারী প্রগতি ঘটাতে পারে না, পারছেও না তার প্রমাণ প্রায় প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে।
মন চাইল আর তৎক্ষণাৎ পোশাকের অজুহাতে একজন নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম—এরকম স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার সভ্য সমাজে স্বতঃসিদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটিই হচ্ছে।
নারী শরীরের কোনো অংশ উন্মুক্ত দেখে যদি কোনো পুরুষের যৌন ক্ষুধা লাফিয়ে ওঠে, তাহলে সেই সমস্যা সেই পুরুষের নিজস্ব। এরূপ বেয়াড়া আবদারকে নিবৃত্ত করার দায় তো কোনো মতেই নারীর নয়। কিন্তু কিছু নারীও যখন এসবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন সমাজকে বোঝানো বড় কঠিন যে, অপরের পোশাক ঠিক কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে কালক্ষেপণ করা অনধিকার চর্চা।
সবার রুচি এক নয়। তা হওয়ার দরকারও নেই। আলাদা রুচির লোক দেখলে যদি আমাদের অনুভূতি আহত হয়, যদি তাকে মারার ইচ্ছা হয়, তাহলে আমরা যখন চিকিৎসা নিতে ভারতে যাই, বেড়াতে যাই নেপালে, কিংবা কাজের সন্ধানে ইউরোপে গিয়ে হাজির হই; তখন কোথায় থাকে সেই রুচির অহংকার, অনুভূতি সুরক্ষার দাপট?
গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, অপমান করার অধিকারও সংবিধান কাউকে দেয়নি। তালিবান শাসনের মতো করে নারীদের দেখার প্রবণতা বাড়ছে। তার ওপর আদালতের এমন স্থুল বুদ্ধিসম্পন্ন রায়ে দেশের আসল চরিত্রটা বেরিয়ে আসে।
হাইকোর্ট দেশের আইনীয় অভিভাবক। বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাষ্ট্রের যেমন বিবেক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, আদালতও তেমনি। আমাদের নানা সমস্যার আইনি সমাধান আদালতই দিয়ে থাকেন। আর এসমস্ত সমাধান বুদ্ধিজীবীদের মতোই সমাজ রাষ্ট্রের জন্য অগ্রসরমান চিন্তা-চেতনারই প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন আদালত। সেখানে আদালতের এমন পশ্চাৎপদ মন্তব্য রাষ্ট্র তথা জাতি এগিয়ে নেওয়ার চেয়ে বরং আমাদের অসভ্য মধ্যযুগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কোনো সভ্য দেশেই আইনের শীর্ষস্থানীয় এমন প্রতিষ্ঠান পোশাক পরা নিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার পক্ষে দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়ালে আর সভ্য থাকা হয় না।
হাইকোর্টের মতামত রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আইনের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত অনুসারেই মানুষ অপরাধ নির্ণয় করে চলে। সেখানে আদালতের এমন মন্তব্য সমাজে সমস্যাটিকে আরও উস্কে দেবে। বিচারকের আসন থেকে এমন মন্তব্য সমীচীন নয়, যাতে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রকাশ পায়।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৫৫১
আপনার মতামত জানানঃ