দেশে সংক্রমণের মতো বাড়ছে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সহিংসতার ধরন বদলাচ্ছে। কিশোর-তরুণেরা ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ২০২১ সালে সারা বছরে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৭৯টি। এ বছরের গত ৮ মাসেই ১৫৯টি দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সাইবার ক্রাইমও বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। সরকারি কোনো উদ্যোগই নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার মূল কারণ দূর করার ক্ষেত্রে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বুধবার নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে এ সভা হয়।
জাতীয় কমিটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আসুন, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা এবং সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভার সভাপতিত্ব করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন এম আমীর-উল ইসলাম।
আমীর-উল ইসলাম বলেন, যখন কোনো দেশের নারীরা সম্মান পান না, তখন কোনো দেশের সমাজেরও সম্মান থাকে না। নারী নির্যাতন মহামারি আকার ধারণ করেছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকটি বাংলাদেশে সবচেয়ে রুগ্ন অবস্থায় আছে। একে আমরা লালন করতে পারছি না, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতাও সুরক্ষিত থাকছে না। এমতাবস্থায় আমাদের চেতনার ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করতে পরিবার, শিক্ষাঙ্গন ও কর্মস্থলসহ সর্বত্র এই তিনটি দিকের চর্চা করার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়া, খবরের কাগজে বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে, সহিংসতাকারীদের স্বরূপ প্রকাশ্যে সবার সামনে উন্মোচন করতে হবে।
কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি ২০১৮ সালে গঠিত হয়। গত দুই বছর করোনার কারণে সক্রিয়ভাবে কাজ করা যায়নি। কোভিড পরিস্থিতি সমাজে নানা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও গণতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক বিদ্যমান পরিস্থিতি সহায়ক নয়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কীভাবে মানবিক, গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে কমিটির করনীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে সবাইকে মতামত দিতে হবে।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা নারীবিদ্বেষী। অনেক নারীও নারীবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে থাকেন। বাংলাদেশে মেয়েদের নানা কারণে দোষী করা হয়। প্রতিটি অনিয়ম-নৈরাজ্যের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, সারাদেশে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটির সভার মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ সাপেক্ষে আগামী ডিসেম্বর মাসে পরবর্তীসময়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য জাতীয় কনভেনশন করা হবে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুস বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমাজের দুর্বৃত্তায়ন নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার অন্যতম কারণ। কোথাও নারী নির্যাতন বা মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে দায়ী করা হয়। রাজনীতিকে শুদ্ধ করে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগানো সম্ভব না হলে সর্বোপরি ৭২ এর সংবিধানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা না গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা, সামাজিক অনাচার কখনোই বন্ধ করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, বাল্যবিবাহ কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যে বাংলাদেশে নয় পাকিস্তান, ভারতেও বেড়েছে। নারীরা প্রতি সহিংসতার মূল কারণগুলো কখনোই নির্মূল হচ্ছে না। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও ধর্ষণ কমছে না। দারিদ্র্যতার মতো সহিংসতা পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব না। তাই বলে হতাশ হওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সদিচ্ছা প্রয়োজন।
অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা নারীবিদ্বেষী। অনেক নারীও নারীবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে থাকেন। বাংলাদেশে মেয়েদের নানা কারণে দোষী করা হয়। প্রতিটি অনিয়ম-নৈরাজ্যের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে।’
নারী খেলোয়াড় ও পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতনবৈষম্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীর জন্য গৃহীত কর্মসূচিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকলে দেশের উন্নয়নের চিত্র বদলে যেত।
দীপ্ত টিভির সিইও ফুয়াদ চৌধুরী বলেন, আমরা জেন্ডার বান্ধব পলিসি প্রয়োগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বর্তমানে সমাজের প্রেক্ষাপটে টেলিভিশন মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কন্যাশিশুর প্রতি অনেক সামাজিক অনাচারের ঘটনা ঘটে, এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে মিডিয়া কাজ করতে পারে।
সাংবাদিক বাসুদেব ধর বলেন, নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার বন্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সভায় নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, তরুণ সমাজকে বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য যৌথ উদ্যোগ আরও কার্যকর করা এবং সমাজের নেতিবাচক প্রবণতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা।
সভায় উপস্থিত ছিলেন- নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্য বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এসএমএ সবুর, অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা, অধ্যাপক ডা. শাহিদা চৌধুরী, রামানন্দ বিশ্বাস প্রমুখ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ