নারী নির্যাতনে তালিকার শীর্ষস্থানে থাকা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ নারী-শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা, এনজিওর করা জরিপ প্রতিবেদনে বিষয়টি স্পষ্ট। তবে জাতীয় জরুরি পরিষেবায়ও এমন তথ্য দেখা যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) পরিষেবাটির পরিসংখ্যানের বরাতে দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে সারা দেশ থেকে ৮ হাজার ৪২টি ফোনকল এসেছে। তার মধ্যে যৌন হয়রানি-উত্ত্যক্তের প্রতিকার চেয়ে কল এসেছে ৭০৩টি।
২০২১ সালে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় ১২ হাজার ১৬৯টি কল এসেছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ৭১টি কল এসেছিল যৌন হয়রানির ঘটনায়। ২০২০ সালে ৯৯৯ নম্বরে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে ৬ হাজার ৩৩১টি কল এসেছিল। তার মধ্যে ৮৯৫টি ছিল যৌন হয়রানিবিষয়ক।
২০১৯ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে ৩ হাজার ১১৫টি কল আসে। তার মধ্যে ৭৩১টি যৌন হয়রানির ঘটনায়। ২০১৮ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে ২ হাজার ২৯২টি কল আসে। এর মধ্যে ৬৯২টি কর ছিল যৌন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে ৯৯৯ নম্বরে এ ধরনের অভিযোগে ফোনকলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে পরিষেবাটির ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, কলের সংখ্যা বেড়েছে মানে যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়ে গেছে, সেটা বলা যায় না। মানুষ আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছে। তাই তারা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে প্রতিকার চাইছে। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে যে প্রতিকার পাওয়া যায়, সে তথ্য মানুষ বেশি করে জানছে। তাই দিন দিন এখানে ফোনকলের সংখ্যাও বাড়ছে। পথেঘাটে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই এখন ৯৯৯ নম্বরে ফোন করছেন।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর (৯৯৯) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যৌন হয়রানির ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে ৯৯৯ নম্বরে ভুক্তভোগী, তাদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, এমনকি এলাকাবাসী বা পথচারীরা ফোন করছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যৌনকামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নিজের অঙ্গ বা বস্তু দিয়ে নারী বা শিশুর যৌনাঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে, কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করলে, সেই কাজ যৌনপীড়ন হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি ৩ থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৬ ধারায় ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা নারীদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার পেছনে মহামারির বিশেষ পরিস্থিতির কয়েকটি দিকের কথা বলছেন। তাদের মতে, কাজ হারিয়ে ফেলায় অনেকেই খাবারের মতো মৌলিক চাহিদার ঠিকমতো জোগান দিতে পারছেন না। অনেকেরই কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চিত পরিস্থিতি হতাশা ও অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই গৃহকর্মী বাদ দেওয়ায় গৃহকাজ বেড়ে গেছে। এতেও পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ বেড়েছে। এসব কারণেই সহিংসতা বাড়ার পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। যৌন হয়রানির শিকার নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না। এটি নির্মূল করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচিও জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০১
আপনার মতামত জানানঃ