রাজধানীর উত্তরা যেন এক শোকস্তব্ধ নগরী। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক, ক্ষোভ আর প্রশ্ন। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩১ জনের মৃত্যু ও ১৬৫ জনের বেশি আহত হওয়ার খবর দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তবে প্রত্যক্ষদর্শী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবি—এই সংখ্যা প্রকৃত নয়। নিহতের প্রকৃত হিসাব গোপন করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নিয়েও রয়েছে সন্দেহ, আর এই সন্দেহই আজ রূপ নিয়েছে সড়কে আন্দোলনে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে উত্তরের আকাশ শুধু বিমানের নয়, মুখরিত হয়েছে শিক্ষার্থীদের স্লোগানে। মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে কয়েক শ শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে ছয় দফা দাবি পেশ করে। তারা বলছে—এই দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। নিহতদের পরিচয় প্রকাশ, আহতদের পূর্ণ তালিকা, সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার ঘটনায় নিঃশর্ত ক্ষমা, ক্ষতিপূরণ, পুরনো যুদ্ধবিমান বাতিল এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতির পরিবর্তন—এসবই তাদের দাবি।
এই বিক্ষোভে মুখোমুখি অবস্থানে পড়েন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। ছাত্রদের তীব্র স্লোগানে তারা একপর্যায়ে একাডেমিক ভবনের ভেতরে আটকা পড়েন। ‘ভুয়া ভুয়া’ ধ্বনি গর্জে ওঠে চারপাশে।
শুধু ক্যাম্পাসে নয়, ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও। দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তারা ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব দে’ স্লোগানে মুখর করে তোলে গোটা এলাকা। তারা শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগ দাবি করে। এর ফলে সচিবালয়ের সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং যান চলাচলে সৃষ্টি হয় বিশাল বিঘ্ন।
এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “রাত ৩টার দিকে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হলো। সকালবেলা আমরা প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পথে শুনলাম পরীক্ষা নেই। এটা কেমন সিদ্ধান্ত?”
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর জাতি যখন শোকে নিমজ্জিত, তখনই আবার প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ব্যবস্থাপনাগত অব্যবস্থা। যুদ্ধবিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানানো হলেও, কেন জনবহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে সেই প্রশিক্ষণ উড়ান পরিচালনা করা হলো? চীনের তৈরি পুরনো এফটি–৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান কি আদৌ প্রশিক্ষণের জন্য উপযোগী ছিল?
দুর্ঘটনার সময় স্কুল ভবনে দগ্ধ শিক্ষার্থীদের আর্তচিৎকার, নিখোঁজ সন্তানের খোঁজে মাতাপিতার আহাজারি—এসব দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয় যুদ্ধের বিভীষিকাও। একটি প্রশিক্ষণ ভুলেই শতাধিক শিশুর জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, অথচ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনো কোনো জবাবদিহিতার ভাষা শোনা যায়নি।
অন্যদিকে, আইএসপিআর জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। আহতদের মধ্যে অনেকেই বার্ন ইনস্টিটিউট, সিএমএইচ, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের কেউ এখনো সংকটাপন্ন।
নিহত শিক্ষিকা মাসুকা বেগমের মরদেহ যখন স্বজনরা বহন করছিলেন, তখন শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল পুরো হাসপাতাল চত্বর। অনেক অভিভাবক এখনো খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের সন্তানদের, অনেকে জানতেও পারছেন না সন্তান জীবিত না মৃত।
এমন এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও তার পরবর্তী ব্যবস্থাপনা আমাদের শিক্ষা ও নিরাপত্তা খাতের সীমাহীন দুর্বলতা ও দায়িত্বহীনতার নগ্ন চিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে। শুধু তদন্ত কমিটি আর শোকবার্তা দিয়ে কি শেষ হবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি? নাকি এইবার শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ রাষ্ট্রের দেয়াল ভেদ করে সত্য ও ন্যায়ের দাবিতে উত্তরণ ঘটাবে?
আপনার মতামত জানানঃ