দেশে গত আগস্টে ২৭৪ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শিশুসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৩ জন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে সাত শিশুকে। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এক শিশুকে।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্টে ১৩১ কন্যাশিশু এবং ১৪৩ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন। ধর্ষিতদের মধ্যে ৬০ কন্যাশিশু। সাত কন্যাশিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ১৫ কন্যাশিশুসহ ২৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এক কন্যাশিশুসহ দু’জনের শ্নীলতাহানি করা হয়েছে। ছয় কন্যাশিশুসহ ৯ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এসিডদগ্ধ হয়েছে একজন। অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে একজনের। এক কন্যাশিশুসহ তিনজনকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। ১০ কন্যাশিশুসহ ১২ জনকে অপহরণ এবং এক কন্যাশিশুকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, নারী পাচারের ঘটনা ঘটেছে দুটি। বিভিন্ন কারণে আট কন্যাশিশুসহ ৩০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া দুই কন্যাশিশুসহ ১২ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে আটজন, এর মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে তিন কন্যাশিশুসহ মোট ১০ জন। নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে দুই কন্যাশিশুসহ পাঁচজন। এ ছাড়া দুই কন্যাশিশুসহ তিনজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। ১২ কন্যাশিশুসহ ৩৪ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে একজন। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে চারটি। ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে একটি। এক কন্যাশিশুসহ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে ছয়জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলমান করোনা পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে সর্বক্ষেত্রে। নারী নির্যাতনের মতো অপরাধও সে কারণেই বাড়ছে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বহু মানুষের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যায়।
এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেপ্তারও করে না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না।
এইসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেপ্তারও করে না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না। এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই অপরাধ কমে যাবে।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় এতদিন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর যদি মৃত্যু হয় বা গণধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় বা আহত হন, তাহলেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধান ছিল। সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলেও একই শাস্তি হবে। যদি কোনো ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি করেন তাহলে এটি যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে। এজন্য ওই ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর এবং ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হবে।
এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, তিনি বা তারা প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু ন্যূনতম পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
নারী নির্যাতন কেন বাড়ছে এবং এ অপরাধ বন্ধ করতে কী করণীয়? এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটি সবাইকে বুঝতে হবে। এ মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সমাজ ও সরকার উভয়ের। নারী নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে বিচারহীনতা বড় অন্তরায়। পরিস্থিতির কারণে নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেয়, বিচারপ্রার্থী হয়। বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে চার শতাংশের কম নারী বিচার পায়। নারী নির্যাতন রোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা।
তারা বলেন, নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে। কিন্তু আইন তো সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। তাই আইন এক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে আছে। অতএব কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে নারী নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করলেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক কাঠোমোর মধ্যে যেসব পরিবর্তন এলে ধর্ষণ কমত, সে পরিবর্তন আনা হয়নি বলেই ধর্ষণ বেড়ে চলছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্য গঠনমূলক পাঠ্যক্রম, পরিবার, সমাজের জেন্ডার সংবেদনশীল ও মানবিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সাংস্কৃতিক ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দেওয়া। এসব জায়গায় এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি। অপরাধ সংঘটনের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে কাজ করে আইন। তাই শুধু সাজা বাড়িয়ে অপরাধ কমানো যায় না। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যা নির্মূল করতে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আইনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যেমন অত্যন্ত জরুরি, তেমনি সমাজে বিরাজমান ধর্ষকামী মনস্তত্ত্ব দমনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশও জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৬
আপনার মতামত জানানঃ