গত ৫০ বছরে জলবায়ু বিপর্যয়জনিত কারণ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দাবদাহে বিশ্বে ২০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব প্রাণহানির ৯১ শতাংশই হয়েছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এ সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সারাবিশ্বে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) এক জরিপে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ডব্লিউএমওর জরিপটি চালানো হয়েছে ১৯৭৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১ হাজারের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে। এই দুর্যোগের তালিকায় রয়েছে ১৯৮৩ সালে ইথিওপিয়ার ভয়াবহ খরা এবং ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আঘাতহানা ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনাও। গত ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হয় ইথিওপিয়ার খরায়। আর ক্যাটরিনায় ক্ষতি হয় ১৬৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার সম্পদের।
জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত শতকের সত্তরের দশক থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাঁচ গুণ বেড়েছে। বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। দেখা গেছে, সত্তরের দশকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেখানে ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ছিল, সেখানে গত দশকে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারে।
এদিকে ক্ষতির পরিমাণ বাড়লেও কমেছে প্রাণহানি। ডব্লিউএমও বলছে, গত শতকের সত্তরের দশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত দশকে মৃত্যুর সংখ্যা কমে প্রতিবছর ১৮ হাজারে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সতর্ককরণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব পেত্তেরি তালাস।
তবে বিপর্যয়ে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার খবরটি ইতিবাচক হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা বেশ আশঙ্কার। গত ৫০ বছরে ২০ লাখ মৃত্যুর ৯১ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হয়েছে বলে জরিপে দেখা গেছে।
গত শতকের সত্তরের দশক থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাঁচ গুণ বেড়েছে। বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। দেখা গেছে, সত্তরের দশকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেখানে ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ছিল, সেখানে গত দশকে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারে।
এদিকে মানুষের কার্যকলাপের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই জুলাই মাসে পশ্চিম ইউরোপে চরম বিপর্যয় দেখা গেছে বলে এক গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে৷ ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন গবেষকরা৷
গত মাসে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল, বেলজিয়ামের পূর্বাঞ্চল, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ ও সুইজারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে৷ ১২ ও ১৫ই জুলাইয়ের বিপর্যয়ের কারণে শুধু জার্মানি ও বেলজিয়ামে কমপক্ষে ২২০ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ বিপর্যস্ত এলাকায় এখনো স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসেনি৷ সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার মাধ্যমে ত্রাণ ও পুনর্গঠনের উদ্যোগ চলছে৷
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় আরও ঘনঘন ঘটছে৷ ‘ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন ইনিশিয়েটিভ’ নামের উদ্যোগের আওতায় এই গবেষণা চালানো হয়েছিল৷ এর আওতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে এখনো পর্যন্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে৷
তাতে দেখা গেছে, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক বৃষ্টিপাতের ঘটনা বাড়ছে৷ অথচ অতীতে প্রতি ৪০০ বছরে এমন ধ্বংসলীলা দেখা যেত৷ গবেষণার ফল অনুযায়ী গড় তাপমাত্রা মাত্র শূন্য দশমিক আট শতাংশ বাড়লেই সেই সময়সীমা ৩০০ বছর পর পর বড় আকারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও বেড়ে চলেছে৷ তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে গবেষকরা মানুষের কার্যকলাপের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনকেই এমন বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করছেন৷
পশ্চিম ইউরোপের বিপর্যস্ত এলাকায় বৃষ্টিপাতের মাত্রা মাত্র এক দিনে তিন শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯ শতাংশ ছুঁয়েছিল৷ একই সময়কালে গড় তাপমাত্রা এক দশমিক দুই শতাংশ বেড়েছে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর তাপমাত্রা মাত্র এক ডিগ্রি বাড়লেই বাতাস বাড়তি সাত শতাংশ পানি শুষে নিতে পারে৷ স্বাভাবিকভাবে সেই পানি ছাড়া হলে প্রবল বৃষ্টিপাত অনিবার্য৷
ইউরোপের ছয়টি দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ জন গবেষক ইউরোপের সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক পূর্বাভাস দিয়েছেন৷ তাদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এমন ঘটনার আশঙ্কা এক দশমিক দুই শতাংশ থেকে নয় গুণ বাড়তে পারে৷ এমন পরিস্থিতি এড়াতে সব দেশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর চেষ্টা চালাতে হবে এবং এমন বিপর্যয়ের জন্য আরও প্রস্তুতি নিতে হবে৷
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ