বিজেপি সরকারের রাজনীতিকে ধর্মীয়করণের অন্যতম হাতিয়ার নিরীহ গরু। ক্ষমতায় বসার পর থেকেই গরুর মহাত্ম প্রচারে কোমর বেঁধে নেমেছে তারা। মূলত দেশটিতে অবস্থিত মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানতেই এই ছক কষে বিজেপি। লোকতন্ত্রের দেশ ভারতে ধর্মীয় ভেদনীতির সফল প্রয়োগে বিজেপি আজ দেশটির কয়েকটি প্রদেশে গোহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এই আইনের বলি হয়েছে অসংখ্য মুসলিম।
আর এই নীতির জন্য গরুকে হিন্দু ধর্মের দেবতার স্থানে বসিয়েছে বিজেপি। তৈরি করেছে নতুন ধর্ম; ‘গো ধর্ম’। এমনকি তৈরি করেছে গো রক্ষা কমিটি। এই আধুনিক যুগেও ভারতে কুসংস্কারের দাপট সর্বত্র। গরুর দুধে সোনা থাকার বিশ্বাস অন্ধ ধর্মপ্রাণ ভারতীয়রা বেশ আগে থেকেই করে আসছে।
এবার আবারও সে কথার পুনরাবৃত্তি করলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। আসল গরুর দুধে সোনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার কলকাতার হেস্টিংসে রাজ্য বিজেপির কার্যালয়ে দলের কৃষক শাখার কর্মসূচিতে তিনি ওই মন্তব্য করেন।
দিলীপ বলেন, ‘‘কলকাতা বা তার আশপাশের জেলায় গরু পালন প্রায় হয়ই না। আমরা প্যাকেট দুধ খাচ্ছি। আমি বলেছিলাম, দুধে সোনা পাওয়া যায়। অনেকে তার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু যারা আসল দুধই খাননি, তারা সোনার দর বুঝবেন কীভাবে?’’ তার দেওয়া বক্তব্যে আলোচনা-সমালোচনাও শুরু হয়েছে বেশ জোরেশোরে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, বিজেপি কিসান মোর্চার সেই অনুষ্ঠানেই রাজ্যে পশুপালনে জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। সেই প্রসঙ্গ পরে ওঠে সংবাদ সম্মেলনেও। অতীতে গরুর দুধ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে দলের বাইরে তো বটেই, ভিতরেও সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন দিলীপ। আক্রমণ শানিয়েছিলেন তৃণমূল নেতারাও। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘দিলীপবাবু যদি সেই আসল গরুর সন্ধান দিতে পারেন, তাহলে তা নিয়ে গবেষণার ব্যবস্থা হবে।’’
এর আগে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ‘গরুর দুধে সোনা’ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে দিলীপ বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। লোকসভা নির্বাচনের পর সদ্য এমপি হওয়া দিলীপ বর্ধমান শহরের টাউনহলে ‘ঘোষ এবং গাভীকল্যাণ সমিতির সভায় দিলীপ বলেছিলেন, ‘গরুর দুধে সোনার ভাগ থাকে। তাই দুধের রং হলুদ হয়। দেশি গরুর কুঁজের মধ্যে স্বর্ণনাড়ি থাকে। সূর্যের আলো পড়লে, সেখান থেকে সোনা তৈরি হয়।
খবরে আরও বলা হয়, দিলীপের এই মন্তব্যের পরে জোর বিতর্ক শুরু হয়। নেটমাধ্যমে তো বটেই; বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরাও ‘দিলীপ-তত্ত্ব’ শুনে অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এমন ‘বৈজ্ঞানিক’ গবেষণা পৃথিবীর কোথাও হয়েছে বলে তাদের জানা নেই।
এর আগেও দিলীপ ঘোষ বর্ধমান জেলায় একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “ভারতীয় গরুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার দুধের মধ্যে সোনার ভাগ থাকে। সেজন্য ওই দুধের রঙ একটু হলদে হয়।”
তিনি ব্যাখ্যাও করেছেন যে কীভাবে গরুর দুধে সোনা মেশে। এ প্রসঙ্গে দিলীপ বলেন, এই বৈশিষ্ট্য শুধু দেশি গরুরই থাকে, বিদেশি গরুর থাকে না। কারণ বিদেশি গরুর কুঁজ থাকে না। মোষের মতো সমান হয় তাদের।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমাদের পুজোতে দেশি গরুর দুধ-ঘি-দই লাগে। বিদেশি গরুর দুধ কাজে লাগে না পুজোয়। আর বিদেশি গরু হাম্বা করে আওয়াজও করে না। তাই ওগুলো গরুই নয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশি গরু হচ্ছে গোমাতা আর যেহেতু ওগুলো বিদেশি, তাই ওদের আন্টি বলা যেতে পারে।” এই মন্তব্যের পরেই সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় মশকরা।
২০১৭ সালে রাজস্থানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানি মন্তব্য করেছিলেন যে গরুই একমাত্র প্রাণী, যারা নিশ্বাসের সময়ে যেমন অক্সিজেন নেয় আবার প্রশ্বাস ছাড়ার সময়েও অক্সিজেন ত্যাগ করে।
একই কথা আবারও বলেছেন বিজেপির নেতা ও উত্তরাখণ্ড রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী টি. এস. রাওয়াত। তার আরও দাবি ছিল যে গরুকে ম্যাসাজ করলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমে যায় আর গরুর কাছাকাছি থাকলে যক্ষ্মারোগ নির্মূল হয়।
মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে নির্বাচিত বিজেপির সংসদ সদস্য সাধ্বী প্রজ্ঞা দাবী করেছিলেন যে তার স্তন ক্যান্সার সেরে গেছে প্রতিদিন নিয়ম করে গোমূত্র পান করার ফলে। তবে তার সেই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন এক ক্যান্সার সার্জেন; যিনি নিজেই সাধ্বী প্রজ্ঞার দু’বার ক্যান্সার অপারেশন করেছিলেন।
গরুর দুধের প্রতিষেধক ক্ষমতা নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বিবিসিকে জানিয়েছেন , “দেশি গরুর দুধে যে প্রতিষেধক ক্ষমতা থাকে, উপকারিতা থাকে, সেটা বিদেশি গরুর দুধে নেই। গরুর দুধ খেয়েই একটা মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।”
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে অনেক সাধু-সন্তরা শুধু গরুর দুধ আর গঙ্গার জল খেয়েই সুস্থভাবে বেঁচে থাকেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ