৫০০ দিন হলো করোনাকালে স্কুল-কলেজের ছুটি। তবু এই ছুটি শেষের নাম নেই। শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের খবর ছুটি বা বন্ধের নোটিশও তাদের জন্য বিরক্তির হয়ে উঠেছে। বিকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে অনলাইন ক্লাস; যার সুবিধা পাচ্ছে না প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী। তবু বড় মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা শুনিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর কয়েক দফায় খোলার ঘোষণা দেয়া হলেও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার স্কুল-কলেজ খোলার অনুমতি দেয়া হয়নি। করোনা মহামারি জুড়ে লকডাউনের মধ্যেও শপিং মল, মার্কেট, খাবার হোটেল, রেস্তোরাঁ খোলা থাকলেও বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা
এরই মধ্যে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় স্কুল-কলেজের চলমান ছুটি আরও এক মাস বাড়িয়েছে সরকার। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতজাল বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের ইতিহাসে প্রথম একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিন পার হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। দীর্ঘ এই ছুটিতে ক্লাসের বিকল্প হিসেবে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে টিভিতে, অনলাইনে। তবে ভার্চুয়ালি এই বিকল্প মাধ্যমে ক্লাস পরীক্ষা চললেও শিক্ষার্থীদের পঠন ও শিখন নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি)-এর যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যেসব সুবিধা থাকা দরকার তা আছে বা ব্যবহার করছে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
মাঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে দৈনিক করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে নারাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে, স্কুল বন্ধ থাকায় একাধারে দীর্ঘ সময় বাসা-বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডা ছাড়া একাকী থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মানসিক চাপ, হতাশা ও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী আবার আত্মঘাতীও হয়ে উঠছে।
গত একবছরে বাংলাদেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের মনস্তত্বের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। অনলাইনভিত্তিক সেসব গবেষণায় সীমাবদ্ধতা থাকলেও, প্রায় সকল জরিপেই উঠে এসেছে এদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা বিষণ্নতা, উদ্বেগ আর মানসিক চাপে ভুগছে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী এরকম মানসিক অসুবিধায় ভুগছে বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়াও আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা-প্রবণতার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও লক্ষ করা গেছে।
দেশব্যাপী ৩ হাজার ৯৯৭ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে শতকরা ৫২.৮৭ ভাগের মধ্যে বিষণ্ণতার উপসর্গ এবং শতকরা ৪০.৯১ ভাগের মধ্যে দূর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্যের উপসর্গ ছিল। আঠার থেকে ২৮ বছর বয়সি ৩৩৩১ শিক্ষার্থীর মধ্যে চালানো আরেক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ১২.৮ ভাগের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
শিক্ষাবিদদের মতে, প্রতিষ্ঠান বন্ধে পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে গেমস, স্মার্টফোন আসক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া অনার্সে সেশন জটে পড়া অনেক শিক্ষার্থী হতাশায় মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ড. আলমগীর হোসেন করোনার এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষা নিয়ে সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে বলেছেন, অনলাইনে কেনাকাটা ভালো করা যায়। কিন্তু শিক্ষা অর্জনে শতভাগ সফলতা আসে না। তিনি পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো এবং ধারাবাহিক শিক্ষাকার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ বন্ধ প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল খোলার পর প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দিয়ে বাচ্চাদের মানসিকভাবে পড়ালেখায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।
এদিকে দীর্ঘ এই বন্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরাও আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ভাড়া বাড়িতে গড়ে ওঠা অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে গেছে। এক পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ৬০ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কিন্ডারগার্টেন আর্থিকভাবে দৈন্যদশায় রয়েছে।
সরকারের কাছে প্রণোদনার আবেদন করেও তারা কোনো সাড়া পায়নি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক স্কুলভবন অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে কিংবা বাসা হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোঃ মিজানুর রহমান জানান, বিগত ৫০০ দিন কত কষ্টে যে আমরা পার করেছি তা বোঝানো যাবে না। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক স্কুলভবন বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার অনেক শিক্ষক অন্য পেশায় চলে গেছেন। আমরা সরকারকে এ কথা বলে বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, আমাদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান মালিকরা আর্থিকভাবে কষ্টে আছেন। কিন্তু কোনো প্রণোদনা আমরা পাইনি। আমাদের ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠানে ১০ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। অনেকের শিক্ষাজীবনই এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ