ঢাকার হলিক্রস বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহার আত্মহত্যার পেছনে শিক্ষকের লোভই মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বলে উঠে এসেছে তদন্তে। তবে এ কারণে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোন সুপারিশ করেনি তদন্ত কমিটি। পারপিতার আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, কঠিন প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি সঞ্চার করে কৌশলে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করার তথ্য পেয়েছে। কয়েক শিক্ষকের প্রাইভেট পড়ানোসহ নানা বিষয়ে উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
তবে তদন্ত কমিটি সরাসরি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করানোর অভিযোগ আনেনি। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মনে করছেন, তদন্ত কমিটি দুই কুল রক্ষা করতে গিয়ে এমন প্রতিবেদন দিয়েছে। যদিও তদন্তে এটা ভালভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, শিক্ষকরা চাপ সৃষ্টি করছেন প্রাইভেট পড়ার জন্য। এজন্য তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কঠিন প্রশ্নপত্র করছেন, এমনকি শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দিচ্ছেন। এসব তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবেদনে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেননি।
গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে হলিক্রসের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহা। তখন অভিযোগ ওঠে, অকৃতকার্য করানোর অপমানে সে আত্মহত্যা করেছে। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রেহেনা খাতুন ও শিক্ষা পরিদর্শক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করে। গত সোমবার প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
পারপিতার সহপাঠী শিক্ষার্থীরা জানায়, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের শিক্ষক রোজলিন সারা ও শোভন রোজারিও অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীকে প্রায়ই টিসি দেওয়ার হুমকি দেন। তারা স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্রদের প্রাইভেটও পড়ান। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, স্কুলের ব্যবস্থাপনারও দায় আছে। পরীক্ষার ফলাফল দেয়ার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ অশোভন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
তদন্ত কমিটির কাছে পারপিতার মা কামরুন নাহার জানান, পারপিতা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে বসন্ত (পক্স) রোগে আক্রান্ত হওয়ায় স্কুল ও কোচিংয়ে যেতে পারেনি। এ জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি খারাপ ছিল। কামরুন নাহার অভিযোগ করেন, শিক্ষক শোভন রোজারিও তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য অভিভাবকদের ফোন করতেন এবং প্রশ্নপত্র কঠিন করে প্রণয়ন করতেন, যেন শিক্ষার্থীরা তার কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়।
পারপিতার সহপাঠী শিক্ষার্থীরা জানায়, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের শিক্ষক রোজলিন সারা ও শোভন রোজারিও অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীকে প্রায়ই টিসি দেওয়ার হুমকি দেন। তারা স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্রদের প্রাইভেটও পড়ান। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, স্কুলের ব্যবস্থাপনারও দায় আছে। পরীক্ষার ফলাফল দেয়ার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ অশোভন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বলা হয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একদিন রেজাল্ট কার্ড দেওয়া হবে। আর অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ডেকে এনে অন্য দিন তাদের হাতে রেজাল্ট কার্ড দেওয়া হবে। এ নিয়ে পারপিতা খুব মানসিক চাপে ছিল। স্কুল থেকে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবককে আলাদাভাবে ডাকার কারণে সেই শিক্ষার্থী বা অভিভাবকেরা আলাদাভাবে চিহ্নিত হন এবং অপমানিত বোধ করেন।
তদন্ত কমিটি বলেছে, শিক্ষক রোজারিও কঠিন প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি সঞ্চার করে পরোক্ষভাবে প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করতেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে যেসব ছাত্রী তার কাছে উচ্চতর গণিত পড়ে না, তাদের পরীক্ষায় অকৃতকার্য করিয়ে দেন, এমন প্রমাণ তারা পাননি। তদন্ত কমিটি হলিক্রস স্কুলের সি এবং ডি শাখার উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গণিত, গণিত ও জীববিজ্ঞান বিষয়ের উত্তরপত্রগুলো ঢাকার প্রতিষ্ঠিত চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ) অভিজ্ঞ শিক্ষকদের (বোর্ড পরীক্ষার পরীক্ষক) দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করায়।
মূল্যায়ন শেষে পরীক্ষকেরা লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, এই তিন বিষয়ের উত্তরপত্রের নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অসংগতি যেমন অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন পাওয়া যায়নি। তবে উচ্চতর গণিত বিষয়ের শিক্ষকেরা মতামত দিয়ে বলেন, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন কঠিন ছিল, যার উত্তর নির্ধারিত সময়ে শেষ করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। উচ্চতর গণিত বিষয়ের দ্বিতীয় অন্তের প্রশ্নপত্র এতটাই কঠিন ছিল, যা একজন শিক্ষকের পক্ষেও বোধগম্য হওয়া কঠিন। বোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের নীতিমালা অনুসরণ করে উচ্চতর গণিতের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়নি।
অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি পূরণের জন্য শ্রেণিশিক্ষক বা বিষয় শিক্ষকের উদাসীনতা দেখতে পেয়েছে তদন্ত কমিটি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে উদাসীনতা, উচ্চতর গণিত বিষয়ের শিক্ষক শোভন রোজারিওর প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে অধিক মনোযোগী হওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব পর্যবেক্ষণের বিপরীতে তারা যেসব সুপারিশ করেছে, তাতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়নি।
তদন্ত কমিটি বলছে, শোভন রোজারিওর হলিক্রস বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, উচ্চতর গণিত এবং সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ে প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি প্রমাণিত। তবে তারা শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেনি। এ ছাড়া অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি পূরণের জন্য শ্রেণিশিক্ষক বা বিষয় শিক্ষকের উদাসীনতা দেখতে পেয়েছে তদন্ত কমিটি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে উদাসীনতা, উচ্চতর গণিত বিষয়ের শিক্ষক শোভন রোজারিওর প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে অধিক মনোযোগী হওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব পর্যবেক্ষণের বিপরীতে তারা যেসব সুপারিশ করেছে, তাতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়নি।
তদন্ত কমিটি সার্বিকভাবে আটটি সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাময়মূলক ক্লাসের ব্যবস্থা করা, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্র নীতিমালা অনুসরণ, অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্নপত্র মডারেশনের জন্য কমিটি করা। এ ছাড়া নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ করা, নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বন্ধ করে পিছিয়ে পড়া বা দুর্বল শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস বা প্রাতিষ্ঠানিক কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোচিং-বাণিজ্য নীতিমালা ২০১২ বিশেষভাবে মেনে চলার সুপারিশ করেছে কমিটি। এ ছাড়া বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা জোরদার এবং প্রতি সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার জন্য একই দিনে সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের আহ্বান জানিয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে সুপারিশ করেছে কমিটি।
জানা যায়, পারপিতা ফাইহা হলিক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির সি শাখার শিক্ষার্থী ছিলেন। সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে সব বিষয়ে পাস করে ২১তম স্থান নিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠে। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের সময় ৩২তম স্থান অর্জন করে। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সুযোগ পায় পারপিতা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক স্টেটওয়াচকে বলেন, শিক্ষকরা সহযোগিতা করলে পরীক্ষায় অকৃকতকার্য হওয়ার জন্য পারপিতাকে আত্মহত্যা করতে হত না। যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপর এরকম চাপ সৃষ্টি করে এবং যার অন্তরালে থাকে প্রাইভেট পড়ানোর লোভ, সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। স্কুল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তদন্ত কমিটি এ বিষয়টি উপেক্ষা করায় পারপিতার মৃত্যু বিফলে যাবে। অথচ এই ঘটনা থেকেই স্কুলগুলোর সংস্কারের দাবি পূর্ণতা পেতে পারত।
আপনার মতামত জানানঃ