একটা সময় ছিল যখন নারীদের শিক্ষা দীক্ষায় আগ্রহ দেখাতেন না অভিভাবকেরা। সেই কুসংস্কার ক্রমশ ম্লান হয়ে এখন দেশের অধিকাংশ নারীরাই শিক্ষার আওতায় চলে আসছেন। তবে নারীদের শিক্ষায় দীক্ষায় অভিভাবকেরা যে এখনো পরিপূর্ণ সচেতন এ দাবি জোর দিয়ে করা যাচ্ছে না।
অনেক নারীই এখনো শিক্ষার বাইরে থাকেন। সমাজ এবং ধর্মের যাঁতাকলে পড়ে নারীরা শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার বিষয়টি সবার আগে সামনে আসে। কেননা দেশে এখনো নারীরা নিরাপদ নয়। এখনো স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের বিষয়ে নারীদের রয়েছে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা। এসব উপেক্ষা করেও যেসব অভিভাবক কন্যাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান তাদের মনে দেখা দিয়েছে নতুন এক আতঙ্ক। রাস্তার বখাটেদের মতো এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে থাকেন।
শুধু পুরুষ শিক্ষক নয়, তাদের হেনস্তাকারীদের মধ্যে সহপাঠী থেকে শুরু করে নারী শিক্ষকও রয়েছেন। অথচ বিপদে তাদেরই হওয়ার কথা ছিল মেয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্রয়স্থল।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হয়। সম্প্রতি ‘সহিংসতার ভয়, আর নয়’ শীর্ষক আলোচনায় গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও জনপরিসরে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হওয়া মেয়েশিশু ও নারীদের অবস্থা জানতে গবেষণাটি করা হয়।
গবেষণায় ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ২ হাজার ২৩২ জন শিশু ও নারী অংশ নেন। বিভাগগুলোর মধ্যে খুলনায় এই হার সবচেয়ে বেশি, ৮৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপরই রয়েছে বরিশাল, ৮০ শতাংশ। আর রাজশাহীতে হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানির নানা ধরন আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায়, পুরুষ শিক্ষকদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে তারা। এরপরই রয়েছে সহপাঠী ছেলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শারীরিক নিগ্রহ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে সহপাঠী বা সিনিয়রদের কাছ থেকে মুঠোফোনে আপত্তিকর মেসেজ পেয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। পুরুষ শিক্ষকদের যৌন হয়রানির শিকার হয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছাত্রী। আর শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করেছে ২১ দশমিক ৩ শতাংশ সহপাঠী। পুরুষ ও নারী উভয় শিক্ষকের কাছে থেকে কটুকথাও শুনতে হয় মেয়ে শিক্ষার্থীদের।
শুধু পুরুষ শিক্ষক নয়, তাদের হেনস্তাকারীদের মধ্যে সহপাঠী থেকে শুরু করে নারী শিক্ষকও রয়েছেন। অথচ বিপদে তাদেরই হওয়ার কথা ছিল মেয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্রয়স্থল।
এসব নিগ্রহের প্রভাব শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডের ওপরও পড়ে। হয়রানির কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পড়ালেখা ছেড়ে দেয় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রায় ১১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। আর ৯০ শতাংশের ওপরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
এতসব হয়রানি নীরবে মেনে নেয় প্রায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৩১ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জানায়, তারা শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবার কাছে অভিযোগ করে।
হয়রানির শিকার হতে পারে, এই ভয়ে ৫৪ শতাংশ বাবা তার মেয়েকে কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে দিতে চান না। অন্যদিকে ৬২ শতাংশ মা তার মেয়েকে স্কুলের পিকনিকে পাঠাতে চান না।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ মা তার মেয়েকে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দিতে চান না। ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মা তার মেয়েকে স্কুলের কোনো বার্ষিক অনুষ্ঠানে যেতে দিতে চান না।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘নারী বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে সহিংসতার শিকার হয়। নারীকে এক সময় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল, নারীকে শুধু প্রজননের জন্য ব্যবহার করা হতো। বর্তমানেও নারীরা ডিজিটাল মাধ্যমসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হয়।’
‘সমাজে নারীরা সমঅধিকার পায় না। শহরে মেয়েরা যতটুকু অধিকার পায়, গ্রামের মেয়েরা সেই তুলনায় অনেক কম পায়।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের কেবল একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া নয়, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষকদের যৌন লালসার শিকার হয়ে ছাত্রীরা এখন বিদ্যালয়ে পা মাড়াতে ভয় পায়। শিক্ষকদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক সম্পর্ক ব্যবহত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের এমন যৌন লালসার কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে নারীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ছে বলে মনে করেন তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠানে সবধরনের যৌন হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।
আপনার মতামত জানানঃ