কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে সংকটে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এটি সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ঘাটতি। তবে এই প্রথম রাজস্ব আদায়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার মাইলফলক পার করল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
করোনার কারণে ক্ষতিটা বড় অঙ্কের
করোনার কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি দিয়ে বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, এনবিআর ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারে না। অথচ ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ বেশি।
করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের করুণ অবস্থা থাকায় বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটি। শিগগিরই এর হিসাব চূড়ান্ত হবে।
দেশের মোট বাজেটের অর্ধেকের মতো জোগান দিয়েছে এনবিআর। বছরের শুরুতে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য এনবিআরকে দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে এনবিআরের ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে এযাবৎকালের রেকর্ড ৮২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছিল। ২০২০ সালের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে সবকিছু বন্ধ থাকার ধাক্কা সামাল দিতে পারেনি রাজস্ব খাত।
প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায়ে সংকটে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের। সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা মহামারিসৃষ্ট কঠোর বিধিনিষেধ।
এ অবস্থান থেকে যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তাহলে বাকি তিন মাসে রাজস্ব আদায় করতে হবে আরও এক লাখ ৫৩ হাজার ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। যা প্রায় অসম্ভব— মনে করছেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তিনটি কমিশনারেট থেকে অর্ধেক রাজস্ব এসেছে
বিদায়ী অর্থবছরে মাত্র তিনটি কমিশনারেট থেকে মোট শুল্ক-করের অর্ধেক এসেছে। তিনটি কমিশনারেট হলো চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস, এলটিইউ ভ্যাট ও এলটিইউ কর। এই তিন কমিশনারেট থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ে শীর্ষে আছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগ হয়। তাই আমদানিকারকদের কাছ থেকে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম কর— সবই আদায় হয়।
বিদায়ী অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সব মিলিয়ে ৫১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বড় বড় ১১০টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এলটিইউয়ের (ভ্যাট) ভ্যাট দেয়।
গত অর্থবছরে এলটিইউ ৪৮ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে। তবে জুলাই মাসে ভ্যাট রিটার্নের আসার পর তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এলটিইউ (কর) আদায় করেছে ২৪ হাজার ১১ কোটি টাকা।
বাকি রাজস্বের অর্ধেক এসেছে ১১০ টি কম্পানি থেকে
বিদায়ী অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে সারা দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৯৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছে। এই টাকার অর্ধেক দিয়েছে দেশের ১১০টি বড় কোম্পানি। এর মানে, দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ভালো ছিল। ভ্যাট খাতের ভরসা ছিল ওই ১১০টি কোম্পানি।
এই কোম্পানির তালিকায় আছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো; মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণ ফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক; সিমেন্ট খাতের শাহ সিমেন্ট, হেইডেলবার্গ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, সেভেন রিং সিমেন্ট; ওষুধ খাতের স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপটা; ব্যাংক খাতের ডাচ্–বাংলা, ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক; আরএকে সিরামিকস ইত্যাদি।
করোনার কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁ, পারলারসহ ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মন্দা গেছে। এসব খাত থেকে এনবিআর খুব বেশি রাজস্ব পায়নি।
বড়রা পাশে থাকার পরও বছর শেষে সার্বিক ভ্যাট খাতে ঘাটতি ১৬ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। এবার ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আবার আয়করেও বড় কোম্পানি ও বড় ব্যবসায়ীরাই ভরসা ছিলেন।
বিদায়ী অর্থবছরে আয়করে ঘাটতি হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। আয়কর আদায় হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আয়করের প্রায় ৩০ শতাংশ দিয়েছে ২৮১টি কোম্পানি এবং তাদের ৯৮৭ জন পরিচালক। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (কর) অধীন এসব করদাতা ২৪ হাজার ১১ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। এই দুর্দিনেও এলটিইউ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ কোটি টাকা বেশি আদায় করেছে।
আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-করের ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল। বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ায় আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আদায় বাড়ে। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ গনমাধ্যমকে বলেন, লকডাউন যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। আমি বরাবরই এর বিপক্ষে। লকডাউন মাসের পর মাস চলতে দেওয়া উচিত নয়। নিম্ন আয়ের মানুষ চলতে পারে না, অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি।
এ রকম একটি পরিস্থিতিতে এনবিআরের রাজস্ব আদায় কমে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে রাজস্ব কোথা থেকে আসবে? পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এনবিআরকেও করনেট বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া উচিত।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদায়ী অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ে এনবিআর ভালো করেছে বলে মনে হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধিও বেশ ভালো। কিন্তু করোনার কারণে অর্থনীতি ভালো নেই। ছোট ছোট ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েছেন। হোটেল-রেস্তোরাঁসহ ছোট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা নেই বললেই চলে। আয়করের ক্ষেত্রে বহু করদাতার আয় কমেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ