‘বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত মন্দার ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে। অর্থনীতির জন্য সামনের সময়কে তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন বলেছেন। তিনি মনে করেন, চলতি ২০২২ সাল কঠিন যাবে, সামনের ২০২৩ সাল হবে আরও কঠিন।’
— আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা।
বিশ্ব অর্থনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দার মুখে পড়লে চাহিদা কমবে। এতে জ্বালানি, খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম কমবে। তাতে স্বল্প আয়ের দেশগুলো আমদানি খরচ ও মূল্যস্ফীতির দিক থেকে সাময়িক স্বস্তি পেলেও আয় অনেক কমবে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। মন্দা দেখা দিলে রপ্তানি আয় নিয়ে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয়ও আরও কমবে। সুতরাং এক বিপদ থেকে রক্ষা পেলেও পড়তে হবে আরেক বিপদে। সুতরাং অর্থনীতির ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা সহজে কাটবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এদিকে, এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে যখন সুসংহত করা প্রয়োজন, তখন অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে বাংলাদেশের। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্যঘাটতি এখন গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের যে ঘাটতি, সেটাও গত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। এর প্রভাবে কেবল চলতি বছরেই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি।
সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে। আবার বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও সংকটে পড়েছে। ফলে সাশ্রয়ের দিকে যেতে হচ্ছে সরকারকে। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ বিপদে পড়েছে আয় নিয়েও। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায় করে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ প্রায় সবার নিচে। ফলে নিজস্ব সম্পদ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
মূল্যস্ফীতি
মূল্যস্ফীতি এখন বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে, গত জানুয়ারি থেকেই বাংলাদেশে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শেষ তিন মাসে বৃদ্ধির গতি অনেকটাই বেশি।
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেই ভালো। ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা মানেই বিপদ। এর চেয়ে বেশি হলে মহাবিপদ। অর্থাৎ বাংলাদেশ বিপৎসীমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে টিকে থাকা কঠিন।
প্রবাসী আয়
কোভিডের মধ্যেও বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধি স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
তবে পরের অর্থবছরেই (২০২১-২২) প্রবৃদ্ধি হয়ে গেছে ঋণাত্মক (-১৫.১২ শতাংশ)। গত ৩০ বছরের শেষ এটাই সর্বোচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তবে প্রবাসী আয় কমে এখন তা কোভিড–পূর্ববর্তী গড় অবস্থায় ফিরে এসেছে।
তবে তখন কোনো প্রণোদনা দেওয়া হতো না। এখন আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়।
বাণিজ্য ঘাটতি
বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুন-মে) মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার। একই সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৪৫৪ কোটি ডলার।
ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি।
আমদানি বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি এবং স্বল্প বৈদেশিক বিনিয়োগের কারণে চলতি হিসাবেও ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর পরিমাণ এখন ১ হাজার ৭২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে সর্বশেষ হিসাবে সার্বিক লেনদেনে ভারসাম্যে ঘাটতি ৩৭১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল উদ্বৃত্ত, ৭৫০ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমায় ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে টাকার মূল্যমান ধরে রেখেছিল সরকার। তখন টাকার কিছু অবমূল্যায়নের সুপারিশ করা হলেও তা মানা হয়নি। এর মাশুল দিতে হচ্ছে এখন।
যেমন গত ১ জানুয়ারি ১ ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, তা এখন ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। অর্থাৎ এ সময়ে টাকা মূল্যমান হারিয়েছে ৮ টাকা ৬৫ পয়সা বা ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ।
রপ্তানি আয়
বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশ তৈরি পোশাকশিল্প থেকে আসে। তারপরের চার শীর্ষ রপ্তানি খাত হচ্ছে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে এ চার খাতের রপ্তানি আয় ছিল ৫১৫ কোটি ডলার।
অর্থাৎ প্রতিটি খাতের রপ্তানি ছিল শতকোটি বা বিলিয়ন ডলারের বেশি। শতকোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয়ের পাঁচটি খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক, পাট ও চামড়া খাতের রপ্তানিকারকেরাও এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ, তাদের ক্রয়াদেশ কমছে।
পোশাকের ক্রয়াদেশে দেখা যাচ্ছে ভাটার টান। গত বছর করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এ সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ এসেছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ কম আসছে। আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে বলে জানান এ খাতের উদ্যোক্তারা।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকই বেশি তৈরি করি। গত মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়াদেশ আসার হার কমেছে। আবার দামও কমেছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ।
দেশের তৃতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। দূষণের দায়ে ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর হয়। সেখানেও দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। বর্তমানে বাংলাদেশি চামড়ার মূল ক্রেতা চীন। বিদায়ী অর্থবছরে ১২৫ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ছিল ৩২ শতাংশ। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এখন ক্রয়াদেশ কমছে এ খাতে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা জ্বালানি ও খাদ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। সে কারণে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোও চামড়াজাত পণ্যের ক্রয়াদেশ দেওয়াও কমিয়ে দিয়েছে।
এদিকে বিদায়ী অর্থবছরে ১১২ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি কমেছিল এ খাতের। বর্তমানে বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইইউ, তুরস্ক ও চীন। পোশাক ও চামড়ার মতো এ খাতের রপ্তানি ক্রয়াদেশও কমছে।
সর্বনিম্ন রাজস্ব আদায়
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখন ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আর নেপালে এ অনুপাত ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং লাওসের ১৩ দশমিক ১৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা চলতি ও আগামী অর্থবছরের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে এ তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, এ দুটি দেশ ২০২৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে। কর-জিডিপি অনুপাতে এখন বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে কেবল দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা—৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
এদিকে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, তাদের সাময়িক হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে।
সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলও এ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটের বর্তমান সময়ে কম রাজস্ব আদায় নিয়ে বিপাকেই পড়ে গেছে বাংলাদেশ।
আয় কম বলে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে, আবার আরও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কায় জ্বালানির দামও বাড়াতে পারছে না। একই সঙ্গে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পেও বরাদ্দ কমাতে হচ্ছে। সরকার এখন মূলত জ্বালানি চাহিদা কমবে, এ অপেক্ষাতেই আছে। এ ক্ষেত্রে ভরসা হচ্ছে আগামী শীত, বেশি বৃষ্টি এবং বিশ্ববাজারে দর হ্রাস।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ