
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডখ্যাত তৈরি পোশাক খাত গত কয়েক মাস ধরে প্রবল এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যেটি বাংলাদেশের একক বৃহত্তম পোশাক রপ্তানি বাজার, সেই দেশটিই এপ্রিল মাসে আকস্মিকভাবে ‘লিবারেশন ডে ট্যারিফ’ নামে এক নতুন শুল্ক কাঠামোর ঘোষণা দেয়, যেখানে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়। এরপর জুলাইয়ে তা ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হলেও ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্থিরতা কাটেনি। অবশেষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী এই শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই স্বস্তি কি সাময়িক, নাকি দীর্ঘমেয়াদী?
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, এই সিদ্ধান্তে আপাতত কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেলেও মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের ওপর শুল্ক যতই কমুক, সেটি এখনো পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। আগে যেখানে মোট শুল্কহার ছিল ১৬.৫ শতাংশ, এখন তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬.৫ শতাংশে। এর অর্থ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদন খরচ কমানো, পণ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং কৌশলগত দরকষাকষিতে পারদর্শিতা দেখানো এখন সময়ের দাবি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শুল্ক কাঠামোতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক ২৫ শতাংশে নির্ধারিত থাকায় আপাতভাবে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া কিংবা পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীরা একই ধরণের শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে। ফলে, বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অবস্থান ধরে রাখার লড়াই আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে।
আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো—ক্রেতাদের মনস্তত্ত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত পোশাকের দাম বাড়লে ক্রেতারা বিকল্প পণ্য বেছে নিতে পারেন কিংবা কম দামে বিক্রির জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। বিজিএমইএ’র পরিচালক ফয়সাল সামাদের ভাষায়, এখন ‘স্ট্র্যাটেজিক নেগোশিয়েশন’ বা কৌশলগত দরকষাকষির সময়। দাম কমাতে ক্রেতারা চাপ দেবে, আর উৎপাদকদের হবে তা সামাল দেওয়ার লড়াই।
তবে সমস্যার মধ্যেও সম্ভাবনা আছে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানিয়েছেন, যদি আমেরিকান কাঁচামাল, বিশেষ করে তুলা, বাংলাদেশের তৈরি পণ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে কিছু শুল্ক ছাড় পাওয়া যেতে পারে। কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাহী আদেশে বলা আছে—যেসব পণ্যে অন্তত ২০ শতাংশ আমেরিকান উপাদান থাকবে, সেগুলোর ওপর অতিরিক্ত শুল্ক প্রযোজ্য হবে না।
এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে কাঁচামাল ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। দেশে আমেরিকান তুলার আমদানি বাড়ানো, ফ্যাব্রিক উৎপাদনে উন্নয়ন আনা এবং সেই সঙ্গে তৈরি পোশাকে প্রযুক্তি ও ডিজাইনের ব্যবহার বাড়ানো এখন অপরিহার্য। শিল্পে উদ্ভাবন এবং নতুন বাজার ধরার সক্ষমতা না বাড়ালে শুধু শুল্ক ছাড় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা যাবে না।
এদিকে বিশ্ব বাণিজ্য রাজনীতির পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ট্রাম্প প্রশাসনের চীনের ওপর চলমান উচ্চ শুল্কনীতি যদি আরও কঠোর হয়, তবে চীন থেকে সরিয়ে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের দিকে আসতে পারে। কিন্তু চীন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিযোগী এবং বিকল্প বাজার ধরার ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে। তাই চীনের নীতির ওপরও বাংলাদেশের ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভর করছে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকার ও পোশাক মালিকরা যে আলোচনার মাধ্যমে ২০ শতাংশ শুল্কে স্থির থাকতে পেরেছে, সেটি অবশ্যই একটি কৌশলগত অর্জন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের মতে, “৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়ানো এবং বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে প্রবেশের সুযোগ রাখা – এটা বাংলাদেশের জন্য সুখবর।”
কিন্তু এই সুখবরকে স্থায়ী করতে হলে দরকার হবে আরও গভীর কৌশল, উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্প খাতের জন্য বিশেষ সহায়তা। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং মার্কেট ডাইভারসিফিকেশন—এই তিনটি বিষয় এখন সবচেয়ে জরুরি।
এই প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কমার অর্থ সব সমস্যার সমাধান নয়। বরং এটি একটি নতুন প্রতিযোগিতার সূচনা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রতিটি পালকে নজর রাখতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে বাণিজ্য কেবল দামের হিসাব নয়, এটি কৌশলের খেলা। আর সেই খেলায় জয়ী হতে হলে আগেভাগেই পরিকল্পনা নিতে হবে—সরকার, শিল্প এবং ব্যবসায়ী সবাইকে একসাথে।
আপনার মতামত জানানঃ