মৌলিক পানি পরিসেবা বিশ্বে প্রতি বছর নারীর ৭ কোটি ৭০ লাখ কর্মদিবস বাঁচাতে পারে বলে আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইড-এর এক নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামীণ বাংলাদেশে কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করা একটি সাধারণ বাস্তবতা। মৌলিক পানি পরিসেবা বিশ্বে প্রতি বছর নারীর ৭ কোটি ৭০ লাখ কর্মদিবস বাচাতে পারে, যা তাদের কাজের সুযোগ ও জীবিকার বিকল্প খুঁজতে সক্ষম করে তুলতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে নারীর অপরিশোধিত শ্রম ওয়াশ খাতে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর কারণে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের আরও অবনতি হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ওয়াশ খাতে পর্যাপ্ত ও লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ এ পরিস্থিতির উত্তরণে এবং একই সাথে জেন্ডার সমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
‘অত্যাবশ্যকীয়: স্বাস্থ্যকর ও সবুজ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে স্যানিটেশন এবং হাইজিনে বিনিয়োগ করুন’— শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামোতে বিনিয়োগ একটি টেকসই ‘সবুজ’ অর্থনৈতিক প্রণোদনামূলক বিনিয়োগের শর্ত পূরণ করে।
পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন প্রকল্পগুলোতে যুক্তরাজ্য সরকারের দ্বিপক্ষীয় বৈদেশিক তহবিল ৮০ শতাংশের বেশি কর্তনের পর এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধিতে (ওয়াশ) বড় অংকের বিনিয়োগ করে সবার জন্য সুপেয় পানি, পরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং হাইজিন নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্যের জন্য পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিনে (ওয়াশ) সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক দাতাদের বিনিয়োগ অপরিহার্য, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং ভবিষ্যৎ অতিমারি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রণীত এ প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়ায় ওয়াশ বিনিয়োগের কিছু কেস স্টাডির উল্লেখ করে এর উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য ও সময়-সাশ্রয়ী সুবিধা বিশেষত নারী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুবিধার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ বন্যার কবলে পড়ে। বন্যার পুনর্বাসন ও ওয়াশ সুবিধা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে ব্যয় হয় প্রায় ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অথচ জলবায়ু সহিষ্ণু পরিসেবার জন্য মাত্র ৯ কোটি ডলার ব্যয় করলে এই ক্ষতি এড়ানো যেতো।
পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধিতে (ওয়াশ) বড় অংকের বিনিয়োগ করে সবার জন্য সুপেয় পানি, পরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং হাইজিন নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার কারণে লবণাক্ত পানির প্রবেশ নিরাপদ পানির দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং এর ফলে প্রতি বছর দুই কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং তাদের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ওয়াটারএইডের প্রধান নির্বাহী টিম ওয়েনরাইট বলেন, ‘মহামারির আগের পরিস্থিতি আবার ফেরত নাও আসতে পারে। কোভিড-১৯ মোকাবেলা, সম্ভাব্য অতিমারির প্রস্তুতি এবং সবুজ বা পরিবেশবান্ধব পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিনকে প্রাধান্য দিয়ে সঠিক কাজটি করতে এবং সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে ওয়াটারএইড সরকার, দাতাসংস্থা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহবান জানাচ্ছে।’
ওয়াটারএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, ‘ওয়াশ খাতে বিনিয়োগ তুলনামূলক কম ব্যয়ে অর্থনৈতিক সুযোগ ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণের সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে। এছাড়া কোভিড পরবর্তী প্রণোদনা ব্যয়ের মূল উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নে এবং ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকিসমূহ মোকাবেলায় এই বিনিয়োগ সহায়ক হতে পারে।’
উপকূলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট
খুলনার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে সুপেয় পানির চরম সংকট চলছে। পানি সংগ্রহের জন্য স্থানীয়দের পাড়ি দিতে হচ্ছে দীর্ঘপথ।
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, তালা, দেবহাটা, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, মংলা, রামপাল, চিতলমারী, মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানি সংকট চলছে। এই এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কমবেশি খাবার পানির সংকটে রয়েছে। এক কলস পানি সংগ্রহের জন্য মহিলা ও শিশুরা ছুটে যান এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে। কোনো কোনো গ্রামে মিষ্টি পানির আধার বলতে আছে ২-১টি পুকুর। তবে অধিকাংশ গ্রামে পুকুরও নেই।
দাকোপ উপজেলার সুতারখালী গ্রামের গৃহিণী আলেয়া বেগম বলেন, “পানির জন্য বর্ষায় আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। বর্ষাকাল যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। বছরের ১২ মাসের মধ্যে বর্ষাকালের ৩-৪ মাস ভালো পানি পাই। বাকি সময়টুকু খাবার পানির তীব্র সংকট থাকে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পানির আধারগুলো অনেক দূরে থাকার ফলে পানির জন্য টিকে থাকার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।”
আলেয়া বেগম জানান, ঘরের সব কাজ শেষে বিকেলে পানি সংগ্রহে বের হন তিনি। ওই দুই কলসি পানি দিয়েই পরদিন সব কাজ করতে হয়। শুধু এটুকু পানি সংগ্রহ করতে তাকে ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করতে হয়।
এভাবেই এ গ্রামের শতাধিক পরিবার পানির জন্য লড়াই করছেন বছরের পর বছর। আর এই লড়াইয়ের অগ্রভাগে থাকেন নারী।
২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রামটি। প্রায় ৫ বছর এলাকাটি ছিল পানির নিচে। সে সময় খাবার পানির সব আধার নষ্ট হয়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশগত নানা সমসয়ায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্ত আইলার প্রলয়ে সুপেয় পানির সবগুলো আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। সেগুলো থেকে এখন আর লবণ পানি সরানো যাচ্ছে না। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে।
সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র মতে, ২০১৮ সালে খাবার পানি নিয়ে উপকূলবাসীর সমস্যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় পুকুর, দীঘি, জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প গ্রহণ করে। একেকটি পুকুরের ব্যয় ধরা হয় ১৯ লাখ থেকে ৬৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। যার অংশ হিসেবে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জেলা পরিষদের ৪৭টি পুকুর খনন করে পিএসএফ দেওয়া হয় খাবার পানির জন্য। পুকুরগুলোর পূর্বকার পাড় হতে ১৮ ফুট গভীর হওয়ার কথা ছিল। এলাকাবাসীর ভাষ্য মতে খননকৃত প্রতিটি পুকুর পাড়ের ওপর ২/৩ ফুট মাটি ফেলে গভীরতা অক্ষুন্ন রাখে। ফলে খনন কাজে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. আরশাদ আলী সংবাদ মাধ্যমকে জানান, জেলায় গভীর, অগভীর নলকূপ, ভিএসএসটি, এসএসটি, পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং-সহ মোট ৪৩৯৮১টি সুপেয় পানির উৎস রয়েছে। এর মধ্যে আশাশুনিতে ৬৫১১টি এবং শ্যামনগরে রয়েছে ৫৪৫১টি। বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫ থেকে ৩০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। অকেজো হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ আরডব্লিউএইচ, পিএসএফ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দেশের দক্ষিণ এই জনপদে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে বৃষ্টি হলে কিছুটা সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২১
আপনার মতামত জানানঃ