একটি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই কেনা হয়েছিল। আইসিইউ বেড, এম্বুলেন্সসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছিল। নিয়োগ দেয়া হয় ৬৮ জন চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৬ মাসের মাথায় হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে রাজধানীর গ্রীন রোডে অবস্থিত পানি ভবনের মেডিকেল সেন্টার। বন্ধ হয়েছে সকল সেবা। চিকিৎসা সরঞ্জাম গুটিয়ে নেয়া হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে পরিচালিত ওই হাসপাতালটির।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাতারাতি বন্ধ ঘোষণা করা হয় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ওই সেন্টারটি। এ ঘটনারও প্রায় এক বছর ৪ মাস অতিবাহিত হলেও মেডিকেল সেন্টারটির পড়ে থাকা সরঞ্জামের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
স্বল্প সময়ে বিপুল খরচের পর হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাঝে। অনেকের মতে, হাসপাতালটি স্থাপনের মাধ্যমে কিছু লোকের পকেট ভরেছে।
দুর্নীতির ভিতর বাহির
তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পর এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাসপাতালের সরঞ্জাম বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের কর্মকা- দুর্নীতি ও অপরাধের শামিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোভিড ম্যানেজমেন্টের নাম করে পানি উন্নয়ন বোর্ড মেডিকেল সেন্টারটি চালু হয়েছিল কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আসার প্রাক্কালে।
২০২১ সালের ১৫ই জুন রাজধানীর গ্রীন রোডস্থ পানি ভবনে যাত্রা শুরু সেন্টারটির। লক্ষ্য ছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জরুরি কোভিড চিকিৎসা প্রদান। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক, উপ-মন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম ও মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের উপস্থিতিতে হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মেডিকেল সেন্টারে মোট ১৩টি বেডের মধ্যে ৫টি আইসিইউ বেড রয়েছে। সার্বক্ষণিক একটি এম্বুলেন্স রয়েছে। ৩০ জন চিকিৎসক ধারাবাহিকভাবে ২৪ ঘণ্টা সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। এরপর ৬ মাসের মাথায় রোগী না থাকার অজুহাত দেখিয়ে মন্ত্রণালয় হাসপাতালটি বন্ধ ঘোষণা করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালটি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন। তবে এটি চালু হতে হতে সংক্রমণ কমে আসে। হাসপাতালে সর্বাধুনিক আইসিইউ সুবিধা রাখা হলেও তা খুব একটা কাজে লাগেনি। হাসপাতাল চালু অবস্থায় মাত্র ৪০ জন রোগী এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই প্রেসক্রিপশন নিয়েছেন। ভর্তির প্রয়োজন পড়েনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৪৭ হাজার ৮০৫ টাকা ব্যয়ে মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করা হয়। বোর্ডের কল্যাণ পরিদপ্তরের অধীনে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
উদ্বোধনের দিন থেকে শুরু করে জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৬৮ জন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহায়ক নিয়োগ দেয়া হয়। ২০২২ সালের ৩১শে জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পেছনের কারণ হিসেবে কোভিড-এর প্রকোপ কমে যাওয়াকে উল্লেখ করা হয়। ইতিমধ্যে জনবলের সম্মানী বাবদ আরও খরচ হয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ ১ হাজার ৬৭৮ টাকা।
পড়ে রয়েছে ১১৪ ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম
বন্ধ ঘোষণার পরদিন থেকে মেডিকেল সেন্টারের সবার চাকরি শেষ হয়ে যায়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কোনো বকেয়াও নেই। হাসপাতাল বন্ধ হলেও পড়ে রয়েছে ১১৪ ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম।
এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে আইসিইউ বেড, এইচডিইউ বেড, আইসিইউ ভেন্টিলেটর, মনিটর, ইনফিউশন পাম্প, অটোক্লেভ মেশিন, ডায়ালাইসিস মেশিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রভৃতি। টয়োটা হাইয়েস মডেলের একটি এম্বুলেন্স রয়েছে এর মধ্যে। হাসপাতাল পরিচালনার জন্য এমন প্রায় ১১৪ ধরনের সরঞ্জাম বর্তমানে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
এসব সরঞ্জামের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের মধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কেউই। গতকাল সরজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পানি ভবনে মেডিকেল সেন্টারের কোনো অস্তিত্ব নেই। কল্যাণ পরিদপ্তরের অধীনে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু রয়েছে। সেখানে একজন মেডিকেল অফিসার কর্মরত আছেন। বিলুপ্ত মেডিকেল সেন্টারের সকল সরঞ্জাম গুটিয়ে ফেলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা বিবেচনা না করে এমন উদ্যোগ গ্রহণ অবশ্যই দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এমনিতে মানুষের খারাপ ধারণা রয়েছে। জনগণের অর্থের অপচয় করে এমন কর্মকা- যারা ঘটিয়েছে মন্ত্রণালয়ের উচিত তাদের বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ওইসময়ে কারা দায়িত্বে ছিলেন, কিসের ভিত্তিতে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা খুঁজে বের করা উচিত। এটা কারো একক সিদ্ধান্তে হওয়ার কথা না। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পারস্পরিক যোগাসাজশে এটা সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। দেশের বহু হাসপাতালে আইসিইউ কিংবা চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট রয়েছে।
এসব পড়ে থাকা যন্ত্রপাতি খুব সহজেই এসব হাসপাতালে স্থাপন করা সম্ভব। এই যন্ত্রপাতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যারা কালক্ষেপণ করছেন তারা এক প্রকার অপরাধ করছেন। অব্যবহৃত অবস্থায় থাকলে এগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। মন্ত্রণালয়ের উচিত সহসাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কল্যাণ পরিদপ্তরের বর্তমান পরিচালক শেখ মাসুদুল হক বলেন, মেডিকেল সেন্টারটি আগের পরিচালকের তত্ত্বাবধানে চালু হয়েছিল। সেটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই চালু হয়েছে এবং বন্ধ হয়েছে। পড়ে থাকার সরঞ্জামের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়েছে। তারা কোনো জবাব দেননি।
এসডব্লিউএসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ