ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশে স্ব-সেন্সরশিপ আরোপের জন্য চূড়ান্ত অস্ত্র বলে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস তাদের ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। যারাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধাচারণ করে লেখালেখি করেছেন তাদের প্রত্যেককেই তিনি শাস্তির আওতায় এনেছেন বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ট কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের নির্যাতনের উদ্দেশ্যে সহিংসতাকারী বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ২০০৮ সালে তার নিজের দল ক্ষমতায় আসার পর চিত্র পাল্টে যায়। ক্ষমতায় বসার পর থেকে তিনি ক্রমশ আরও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেন। গণমাধ্যমের প্রতি তার এই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব চূড়ান্তরুপ লাভ করে ২০১৪ সালে, যখন প্রধান বিরোধীদলটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় এবং নির্বাচনে তার জয়লাভ আরো সহজতর হয়ে ওঠে।
যদিও তিনি দাবি করেছেন গণমাধ্যমের প্রতি তার সম্মান অটুট রয়েছে এবং একইসাথে গণমাধ্যমে কোনো সমালোচনা সহ্য করা হবে না মর্মে ঘোষণা দেন। এতে তার ক্ষমতা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলে, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার অস্ত্রটিতে আরো শাণ দেওয়া হয় এবং একইসাথে সাংবাদিকদের সেন্সর করার জন্য এক চূড়ান্ত অস্ত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার দায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলে, যেসকল সাংবাদিক ও ব্লগার সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে লেখালেখি করেন তাদের জব্দ করার জন্যই মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি। আইনটি কার্যকর করার পর থেকে এই আইনের আওতায় প্রায় ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে যার মধ্যে ৭০ জন সাংবাদিক ও ব্লগার আছেন।
আইনটির অধীনে যারাই কারাবন্দি হয়েছেন তাদের এমন বীভৎস নির্যাতন করা হয় যে তাদের মধ্যে একজন লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলে, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমর্থকরা তার এই আইন প্রয়োগকারী হিসাবে মাঠে কাজ করে। তারা বিক্ষোভ বা নির্বাচন পরিস্থিতির সংবাদ কভার করতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চায়। এতে বহু সাংবাদিকই আহত হয়েছেন, অনেকে মারাও গেছেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করে। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম।
২০২০ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১তম। আর ২০১৯ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫০তম। অর্থাৎ, গতবারের সূচকেও বাংলাদেশের এক ধাপ অবনতি হয়েছিল।
সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (১৪৫), ভারত (১৪২), মিয়ানমার (১৪০), শ্রীলঙ্কা (১২৭), আফগানিস্তান (১২২), নেপাল (১০৬), মালদ্বীপ (৭৯), ভুটান (৬৫)।
সূচকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস সংকট এবং লকডাউন চলাকালে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশ ও বেসামরিক সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মহামারি ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য অনেক সাংবাদিক, ব্লগার, কার্টুনিস্ট গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।
আর বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে সরকারের কাছে এখন একটি বিচারিক অস্ত্র আছে। তা হলো ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’র দায়ে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছরের কারাদণ্ড। ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণ (সেলফ-সেন্সর) অভূত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সম্পাদকেরা সংগত কারণেই জেল বা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঝুঁকি এড়াতে চান।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর সরকার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে লক্ষণীয় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে সহিংসতার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকেরা। তাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওয়েবসাইট ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।
যেসব সাংবাদিক দুর্নীতি বা স্থানীয় অপরাধী চক্র নিয়ে অনুসন্ধান করেন, তারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজের বৈষম্য, আইনের স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এক প্রকার মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সাংবাদিকদের। দমননীতির কাছে অসহায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম। সত্যকে সামনে আনলে নেমে আসছে আইনের খড়গ। তাই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের এই অধঃপতন অনেকটাই প্রত্যাশিত।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ