জাকির হোসেন
হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ সুতপা এবং তার বংশধর। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার রাজাবাড়ি ইউনিয়নে চন্ডালরাজা প্রতাপ ও প্রসন্নপালের রাজধানী এবং চর্যাপদ কবি “ভুসুকুপা” এর ঐতিহাসিক কাহিনী।
আপনার কাছে কেমন লাগবে যদি আপনি জানেন, রাজাবাড়িতে (শ্রীপুর, গাজিপুর) বসে হাজার বছর আগে কেউ বৌদ্ধগান “চর্যাপদ” রচনা করেন? অসম্ভব তাই না?
হ্যাঁ, সে ধরণের ঘটনাই হয়ত এখানে ঘটেছিল। কেউ হয়ত এখানে বসে প্রথম “বাঙালি” শব্দটি উচ্চারণ করেছিল?
“বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।”
প্রথমেই আসি রাজাবাড়ির ইতিহাস নিয়ে। এই আলোচনায় উঠে আসবে হারিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ সুতপা ভাওয়াল রাজাবাড়িতে আসেন। এখানেই তার ছেলে জয়দেব এর জন্ম হয় এবং তার নাতীরা ছিলো চন্ডালরাজা প্রতাপ ও প্রসন্নপাল। আরো উল্লেখ করব, তারা কীভাবে চর্চাপদ কবি ভুসুকাপা’র বংশধর হন!
এটা আমি বের করবো শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা (শ্রীমত্ বিচরন পাগল) এবং বিখ্যাত ইতিহাস গবেষক শ্রীযতীন্দ্রমেহন রায় রচিত ১৯১২ সালে প্রকাশিত “ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থের রেফারেন্সের তুলনামূলক সাদৃশ্য দেখিয়ে। এ রেফারেন্স এর মাধ্যমেই উঠে আসবে মতুয়াধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ ছিল আমাদের রাজাবাড়ির চন্ডালরাজা প্রতাপ ও প্রসন্নের বংশধর!
তার আগে জানা দরকার রাজাবাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে…
আমাদের গাজীপুরের শ্রীপুর থানার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুখানিয়া গ্রামে বান্দান বাড়িতে আছে চান্ডালরাজা প্রতাপ ও প্রসন্নের স্মৃতিবিজড়িত রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ। রাজাবাড়ির পূর্বনাম ছিল ভাওয়াল রাজাবাড়ি। শেষে ভাওয়াল নামটি বাদ দিয়ে শুধু “রাজাবাড়ি” ডাকা হয়। এর নাম পূর্বনাম ছিল সম্ভবত “ভাওয়াল নগর”। পূর্বতন পালরাজা ভবপাল তার রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করেছিল এই রাজাবাড়িতেই। সেই থেকে ভবপালের নামে রাজধানীর নাম হয়- “ভাওয়াল নগর”। পরবর্তীতে হিন্দু-সেনদের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধশাসকদের “চন্ডাল” বলে অবিহিত করত।চন্ডালরাজা প্রতাপ ও প্রসন্নপালের রাজবাড়িটি বর্তমানে এখাকার “সারা রিসোর্ট” এর ভেতরে আছে।
(বি:দ্র: লেখক ও গবেষক আমিনুল হক সাদী জানান, মুসলিম শাসনপূর্ব সময়ে ঢাকা ও পাশের এলাকায় পাল (৮৫৫-৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) ও সেন (৯৮৬-১২০৩ খ্রিষ্টাব্দ) বংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল।)
“শ্রীপুরের ইতিহাস ও কৃষ্টি” গ্রন্থে অধ্যাপক রেয়াজউদ্দীন আহমদ এবং “গাজীপুরের ইতিহাস” গ্রন্থের লেখক প্রয়াত আব্দুর রশিদসহ অনেকের মতে, প্রথমদিকে আমাদের রাজাবাড়ি ছিল বৌদ্ধরাজা শিশুপালের রাজ্য। কাপাসিয়ার দুর্গ দরিয়াতে তার বাড়ি ছিল (একে স্থানীয়রা “সারা রানীর” ভিটা বলে চেনে)। তার রাজধানী ছিল রানীগঞ্জের একডালা দুর্গের কাছে এবং তার বাগানবাড়ি প্রাসাদ ছিল মাওনার পশ্চিমে শৈলাটে। তার ছেলে কর্ণকীর্তি শাসন করত গোসিংগা ইউনিয়নের কর্ণপুর এলাকা। কর্ণকীর্তির ছেলে ছিল শ্রীকীর্তিপাল বা শ্রীপাল। যার নামে শ্রীপুর থানার নামকরণ হয়। শ্রীপালের ছিল দুই ছেলে – ইন্দ্রপাল এবং ভবপাল। ইন্দ্রপালের রাজধানী ছিলো আধুনা “বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক” এলাকায় ইন্দ্রাকপুরে এবং ভবপালের রাজধানী ছিল আমাদের ভাওয়াল রাজাবাড়ী এলাকায় চিনাশুকানিয়া গ্রামে। তারা ছিল স্থানীয় সামন্ত রাজা। তৎকালীন ভাওয়ালের বিখ্যাত নদীবন্দর ছিলো এই রাজাবাড়ির পারুলী নদী। তখন এটি নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বৌদ্ধ রাজাদের রাজকর্মচারী ছিল এখানকার হিন্দু, বৌদ্ধ- চন্ডালসহ স্থানীয় আদিবাসীরা। চন্ডালরা এখানে মাছধরা, নৌ-বাণিজ্য, নৌবাহিনী, গার্হস্থ্য অর্থনীতির নেতৃত্ব দিত।
সেন আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক বিজয়সেনের আমলে বৌদ্ধ ও চন্ডাল জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় এবং তার ছেলে বল্লাল সেনের আমলে চন্ডাল শাসনের অবসান হয়।
তখন বল্লাল সেন ঘোষণা করেছিলেন, বাংলার সমস্ত বৌদ্ধরা হয় ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করবে, নয়তো মৃত্যুকেই বরণ করবে। যারা বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল, তারা শূদ্রবর্ণে ঠাঁই পেয়েছিল। আর যারা ব্রাহ্মণ্যধর্মে আসেনি তারা রাজশক্তির ভয়ে পালিয়ে নদীনালা, খালবিল, জল-জঙ্গলপূর্ণ দুর্গম অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং ডোম, চন্ডাল, মুচি, কামলি, ব্যাধ, জেলে, ধুনুরি, তাতি, পতিতা ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হয়।
চন্ডাল নামটি কোন গালি নয়, এটি বাঙালিদের আদি পরিচয়। চন্ডাল একটি বল-বীর্য সমন্বিত অর্থ দ্যোতক শব্দ। চন্ডের সঙ্গে জাতি সূচক আল প্রত্যয় যুক্ত হলে চন্ডাল হয়। এমনি ভাবে লাঙ্গল, জোঙ্গাল, জঙ্গল, ডাঙ্গাল, বহাল, খেড়ওয়াল, সাঁওতাল, বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলেই চণ্ডাল শব্দের গুনগত এবং অর্থগত অভিব্যক্তিটি যথার্থ প্রতিভাত হয়ে উঠে। মনে হয় এই চন্ডাল শব্দটিই পরিবর্তিত হয়ে বঙ্গাল বা বাঙলা শব্দে পরিণত হয়েছে।
চন্ডালরা কঠোর শ্রমশীল উৎপাদক, স্বনির্ভর, সৎ এবং অত্যন্ত সাহসী জাতি ছিল। এরা হৃদয়বাণ ও ধর্মপরায়ণ। তাদের ব্যাপারে ইতিহাস গবেষক রিজল বলেন, চন্ডালরা ছিলো সর্বকর্ম পারঙ্গম। তারা নৌচালনা, মৎস শিকার, যুদ্ধবিদ্যা, কৃষিবাণিজ্য, বাস্তুবিদ্যা এবং চিকিৎসা (চাঁদসী) বিদ্যায় দক্ষ ছিল। জলে এবং ডাঙ্গায় এরা সমান পারদর্শী ছিল। এরা এস্ফিভিয়াস অর্থাৎ উভয়চর!
চন্ডালদের তথাকথিত কোনো ধর্ম ছিল না। সততা, বীরতা ও মানবতা ছিল যাদের অন্যতম সহজাত বৈশিষ্ঠ এবং এরা ছিল সু-সংস্কৃতিবান।
চন্ডালদের রমণীরা ছিলো যথেষ্ট স্বাধীনতাভোগী। তাদের ঘরের পুরুষেরা একে অন্যের রমণীদের অনায়াসে নিজেদের জীবনে তুলে নিত। সমাজ বা সংস্কারের ভয় তাদের ছিল না। তারা শিক্ষিত বা অভিজাত বা বংশ গৌরবে গৌরবান্বিত ছিল না। তারা এসবের ধারও ধারত না। তাদের ভেতরে রিপুর তাড়নাকে তারা খারাপ দৃষ্টিতে দেখত না। কারন তারা ছিল প্রকৃতির সন্তান, স্বাধীনচেতা একদল মানুষ।
মুসলিম আমলে চন্ডালদের একটা বড় অংশ মুসলমান হয়। কিছু খ্রিস্টানও হয়। আর বাকীরা ১৯১১ সালে নিজেদের “চন্ডাল” জাতির নাম পরিবর্তন করে নমঃ ব্রাহ্মণ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। এর কারন ছিল, তাদের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তাসহ রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সুযোগ সুবিধার জন্য আইন সভায় সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব করা। তখন গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে নমোদের চন্ডাল গালাগালি থেকে অব্যহতি দেবার লক্ষেও এ সম্প্রদায়কে নমঃশূদ্র নামে নিবন্ধন করানো হয়। ফলে এদের চিরকালীন “চন্ডাল” জাতির নাম পরিচয় হারিয়ে যায়। বর্তমানে নমঃশূদ্র নামে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে তারা “মতুয়াধর্ম” সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। দেশভাগের পর এদের বড় একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়।
এবার রাজাবাড়ির চন্ডালরাজা প্রতাপ, প্রসন্ন এবং হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ সুতপা সম্পর্কে আলোচনা করছি…
মতুয়াধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হারিচাঁদের পূর্বপুরুষদের জীবনীতে প্রতাপ এবং প্রসন্ন নামে দুইজন নমঃশূদ্র-চন্ডাল রাজার নাম পাওয়া যায়। যারা ভাওয়ালেতে বাস করতেন। নমঃশূদ্ররাজা মানে পর্বেকার চন্ডালরাজা!
অন্যদিকে “ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থে প্রায় একই কথা আছে আমাদের গাজীপুরের শ্রীপুর থানার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুকানিয়া গ্রামের প্রতাপ ও প্রসন্ন নামক চন্ডালরাজা সম্পর্কে। এই দু’টি চরিত্র একই ব্যক্তি কিনা সেটাই এখন সন্ধান করব। চলুন তাহলে এই দুটি ইতিহাস কি রকম?
(আমি এর গুরুত্বপূর্ণ “পদ”গুলোর ভেতর শ্রীযতীন্দ্রমোহন রায়ের “ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যগুলো সংযোজন করে দুইটি তথ্যকে একত্র করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করব প্রতাপ ও প্রসন্ন-ই হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ এবং তাদের জন্মভিটা আমাদের ভাওয়াল রাজাবাড়িতেই।)
হরিচাঁদের পূর্ব্বপুরুষদের বিবরন…
শুনিতে পাইল ক্রমে সব বিবরন। মর্ম ব্যথা পেয়ে মুনি করে বিচরন।।
মনে ভাবে হয়ে ব্রহ্মকুলে অত্যাচার। এ স্থান ত্যজিতে এবে উচিত আমার।।
এবে দেখি কোথা যত দেবল ব্রাহ্মন। কি ভাবেতে কালক্ষয় করে সর্বজন।।
এত বলি ভাওয়ালেতে করিল গমন। দেবল ব্রাহ্মনগনে পাইল তখন।।
(ভাওয়াল মানে গাজীপুর জেলা। গাজীপুরকে ভাওয়াল পরগণা বলে। এখানে উল্লেখিত ভাওয়াল হলো “ভাওয়াল রাজাবাড়ী”, শ্রীপুর, গাজীপুর।)
আদ্যোপান্ত বিবরন সকল শুনিল। প্রকৃত ব্রাহ্মন বলে জানিতে পাইল।।
রহিল তাদের সনে হইয়ে মিলন। কে খণ্ডাতে পারে বল বিধির লিখন।।
তা সবার পাশে দিল নিজ পরিচয়। সকলে রহিল তথা আশ্বস্ত হৃদয়।।
ক্রমে তারা সুতপার গুনে বাধ্য হল। সুতপাকে গুরুবলি স্বীকার করিল।।
(“সুতপা” -পদ রচয়িতাদের নামের শেষে পা বা, পাদ যুক্ত করে লেখা হত। চর্যাপদের কবিদের অনেক জায়গায় লুইপা, ভুসুকুপা কুক্কুরীপা, ডোম্বীপা, সরহপা, দারিকপা, কাহ্নুপা, শান্তিপা, কাহ্নপাদ এগুলো লেখা দেখবেন। যারা পদ রচনা করেন তাদের নামের শেষ পাদ বা, পা যুক্ত করা হয়। সুতপার নাম দেখে মনে হয় উনি চর্যাপদের কোন রচয়িতা ছিলেন।)
সুতপা ও তাহাদের ভক্তিবাধ্য হিয়ে। নমঃশূদ্র কন্যা এক করিলেন বিয়ে।।
(বলা হয়, তার পূর্বপুরুষ, উত্তর বিহারের মিথিলা অঞ্চলের একজন ব্রাহ্মণ সাধু পুরুষ ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গে এসে নমশূদ্র (চন্ডাল) কন্যার পণি গ্রহণ করেছিলেন। তারপর থেকে বংশটি নমঃশূদ্র বলে পরিচিত হয়। এই একই ঘটনা আছে চর্যাপদের রচয়িতা “ভুসুকুপা” এর জীবনীতে। ভুসুকুপা বৌদ্ধ পন্ডিত ও সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। তিনিও পূর্ববঙ্গে এসে চন্ডাল কন্যা বিয়ে করেন।)
সেই গর্ভে জন্মিলেন পুত্র একজন। জয়দেব বলি নাম রাখে সর্ব্বজন।।
তাঁর হল এক কন্যা দুইটি নন্দন। প্রতাপ প্রসন্ন নাম সর্ব্ব সুলক্ষন।।
(সকল ইতিহাসবিদ একমত যে, গাজীপুর জেলার, শ্রীপুর থানার রাজাবাড়ির চন্ডাল রাজা ছিলো “প্রতাপ এবং প্রসন্ন” নামের দুই ভাই।) শ্রীযতীন্দ্রমোহন রায় রচিত “ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থের প্রথম খন্ডে বর্ণিত হয়,
“রাজাবাড়ী নামকস্থানে প্রতাপ এবং প্রসন্ন রায় নামক ভ্রাতৃদ্বয় সুন্দ উপসুন্দের ন্যায় এদতঞ্চলে রাজত্ব করিতেন। ইহাদের অত্যাচারে ভাওয়াল জনহীন হইয়া পড়ে। ” মুগ্গী” নাম্মী তাহাদের এক প্রতাপশালীনী সহোদরার নাম প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহাদিগের রাজ্য সম্ভবতঃ কতিপয় গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জয়দেবপুরের উত্তর পূর্বদিকে ইঁহাদিগের রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হয়। লোকে উহা চন্ডাল রাজার বাড়ি বলিয়া অবহিত করিয়া থাকে। প্রতাপ এবং প্রসন্ন রায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন বলিয়া আমাদিগের বিশ্বাস।”
এই তথ্যের টিকাকরণের লেখক যতীন্দ্রমোহন উল্লেখ করেন,
“বৌদ্ধধর্ম্মের অবসানে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী রাজাকে ঘৃণার চোখে চন্ডাল বলিয়া অভিহিত করা অসম্ভব নহে।”
“রাজাবাড়ীতে প্রাপ্ত একখণ্ড প্রস্তরলিপি লন্ডনের মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
“ঢাকার ইতিহাসের” দ্বিতীয় খন্ডে আছে (৪৭১-৪৭১পৃষ্ঠা) “রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে অনতিদূরে এবং আধুনিক জয়দেবপুরের দশক্রোশ উত্তর-পূর্বে “রাজাবাড়ী” নামক স্থানে প্রতাপ ও প্রসন্ন রায় নামধেয় চন্ডাল জাতীয় ভ্রাতৃদ্বয় রাজত্ব করিতেন। কোন সময়ে, কিরূপ ঘটনাচক্রে এই চন্ডাল ভ্রাতৃদ্বয় ভাওয়ালের একাংশে আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তাহা অদ্যাপি তিমিরাবৃত্ত রহিয়াছে। “পূর্ববঙ্গে পাল রাজাগণ প্রণেতা লিখিয়াছেন, “গৌড়ের পাল রাজাগণের রাজত্বকালে যে রূপ নানা নিন্মজাতীয় ব্যক্তির বিদ্রোহের বিবরণ আমরা প্রাপ্ত হই, শিশুপালের অথবা তৎ বংশধরগণের রাজত্বকালেও আমরা তদ্রুপ চন্ডাল বিদ্রোহের জনপ্রবাদ শুনিতে পাই। শিশুপাল অথবা তদীয় বংশধরগণের মধ্যে কাহারো রাজত্ব সময়ে প্রতাপ ও প্রসন্ন নামে চন্ডাল জাতীয় দুই ভ্রাতা একটি স্বতন্ত্র রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। শিশুপাল কোন সময়ে ভাওয়ালে রাজত্ব করিয়াছিলেন তাহাও অতীতের তিমিরের গর্ভেই নিহিত রহিয়াছে। বিশেষতঃ পাল রাজগণের সময়ে বরেন্দ্রে যে কৈবর্ত্ত বিদ্রোহ আরম্ভ হইয়াছিল, তাহা সম্ভবতঃ কোন জাতি বিশেষের মধ্যে নিবন্ধ ছিল না। অত্যাচার প্রপীড়িত গৌড়ীয় প্রকৃতি পুঞ্জই কৈবর্ত্ত রাজের অধীনে দলবদ্ধ হইয়া পাল সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছিল। ভাওয়ালের এইরূপ কোন ঘটনার পুনরাভিনয় হইয়াছিল কিনা তাহার জানা যায় নাই।” তার পরের “পদ”এ যাই…
নন্দিনীর নাম রাখে ভগবতী নামে। বিবাহ হইল তার কলাকোপা গ্রামে।।
(“ঢাকার ইতিহাসে” প্রতাপ এবং প্রসন্নের বোনের নাম – “মুগ্গী”। কিন্তু এখানে এসেছে “ভগবতী” নামে। তার বিয়ে হয় কলাকোপা গ্রামে। কলাকোপা বর্তমানে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় ইছামতী নদীর তীরে অবস্থিত। সেখানে আছে প্রাচীন খেলারাম দাতার বিগ্রহ মন্দির, মহামায়া দেবীর মন্দিরের বাইরে অনেক পুরনো ভবন ও মঠ।
“মুগ্গী” এবং “ভগবতী” নাম দু’টির সমস্যা :
এই নাম দু’টির মধ্যে এই সমস্যাটির সমাধান আছে। যেমন -উর্দুতে মুগ্গী অর্থ “হাবস”। রোমান উর্দুতে মুগগীর উচ্চারণ হ’ল “হাবস “এবং উর্দু রচনামূলক লিপিতে মুগগীর অনুবাদ হبس। হাবশি নামটির উৎপত্তি হয় আরবী আল-হাবশ থেকে। আরবরা আল-হাবশ বলতে বুঝাতো আবিসিনিয়াকে। ইথিওপিয়ান/ আবিসিনিয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেনরা এই উপমহাদেশে পণ্যের সাথে কৃতদাসও নিয়ে আসত এবং বিক্রি করে দিত। হাবশিরা শারিরীক ভাবে অনেক শক্তিশালী ছিল এবং অনেক কাজ করতে পারত, তাই ধীরে ধীরে উপমহাদেশে হাবশি কৃতদাশের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাহিদার সুযোগ নিয়ে পর্তুগীজ নাবিক এবং ব্যবসায়ীরা আফ্রিকা থেকে কৃতদাশ ধরে নিয়ে এসে এই উপমহাদেশ বিক্রি করে মুনাফা করত। অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ রচিত “শ্রীপুরের ইতিহাস ও কৃষ্টি” নামক গ্রন্থে এই মুগ্গী” ব্যাপারটি পরিষ্কার করেছেন। তিনি মুগ্গীকে এলাকার লোকমুখে প্রচলিত মেঘী হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি গাজীপুরের “শ্রীপুরের ইতিহাস ও কৃষ্টি” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “১৫৯৯ সালে হাকিম-ই হুকুমত রাজা মানসিংহ টোকনগর হইতে বাংলার রাজধানী অস্থায়ীভাবে এই রাজাবাড়ীতে স্থানান্তর করেন। ১৬০২ সালে পুনরায় ঢাকায় স্থানান্তর করেন। কথিত আছে যে, তাহার এক “উপপত্নী” মেঘি নামে পরিচিত ছিল। সে এখানে বাড়ি নির্মাণ করে এবং একটি বিরাট দীঘি খনন করায়। ইহাই মেঘির দীঘি নামে পরিচিত।” এখন মুগ্গী যেহেতু মেঘি এবং সে যেহেতু হাবসি কৃতদাসী, -উপপত্নি তাই ব্যাপারটা একেবারেই পরিস্কার -এই মুগ্গী প্রতাপ এবং প্রসন্নের কেউ নন। সে মুঘল সেনাপতির উপপত্নী- মুগ্গী>মেঘি। রাজাবাড়ির পূর্বদিকে পাবুরের পরে ২৫ একর জায়গায় যে মেঘিরদিঘী সেখানে সে থাকত। সে হিন্দুও নয়।আবিসিনিয়রা হিন্দু নয়।শ্রীযোগেন্দ্রমেহন রায় রচিত “ঢাকার হতিহাসে বর্ণীত ” মুগ্গী” নাম্মী তাহাদের এক প্রতাপশালীনী সহোদরার নাম প্রাপ্ত হওয়া যায়।”-তথ্যটি সম্ভবত ভুল! কেননা, চন্ডাল কন্যার নামের অর্থ কখনও উর্দু, আরবী শব্দ হতে পারেনা। এখানে উল্লেখিত “ভগবতী”-ই সঠিক। কেননা, ভগবতী সংস্কৃত উৎসের একটি শব্দ, যা নারী দেবদেবীদের সম্বোধন করার জন্য বা সম্মানের উপাধি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। “ভগবতী” শব্দটি দেবী বা ঈশ্বরীর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। যা কেবল স্থানীয় হিন্দু কিংবা চন্ডাল নামের ক্ষেত্রেই হতে পারে। অতএব, শ্রী যতীন্দ্র মোহন রায়ের উল্লেখিত “মুগ্গী” তাদের বোন তথ্যটি সঠিক নয়। তাদের বোন- ভগবতী। ভগবতীর বিয়ে হয়েছিল ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় ইছামতী নদীর তীরে কলাকোপায়। এটি এখন ইউনিয়ন।)। তারপরের পদ…
মহাবল পরক্রান্ত পুত্র দুইজন। অস্ত্রে শস্ত্রে বিশারদ যুদ্ধে বিচক্ষন।।
ভাওয়ালের রাজা পিতৃ নাম পুরি। অদ্যাপিও কহে সবে জয়দেব পুরি।।
(এখানে ভাওয়াল রাজাবাড়ীকে জয়দেবপুরি বলা হয়েছে। হাজার বছর আগে হয়ত রাজাবড়ির নাম “জয়দেবপুর”-ই ছিলো। বর্তমান জয়দেবপুরের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই।)
নমঃশূদ্রগন তথা প্রতাপের সনে। পূর্ব্ব দুঃখ পাশরিয়ে রহে একমনে।!
বল্লাল আশ্রিত বিপ্র যত জন ছিল। এ সব জানিয়া তারা প্রমাদ গনিল।।
মহাবল পরাক্রান্ত তারা যদি হয়। নিশ্চয় শাসিবে পরে হেন মনে লয়।।
অতএব এবে সবে হও সতর্কিত। সুযোগ পাইলে তারা শিসিবে নিশ্চত।।
এত বলি সবে মিলি করিল মন্ত্রনা। তাগিদে মারিয়া ভাই ঘুচাও যন্ত্রনা।।
কৌশলেতে তা সবাকে করহ নিধন। রক্ষা যদি কর সবে আপন জীবন।।
কেহ বলে চল তবে দুই চারিজন। সঙ্গে করি বৃদ্ধ বিপ্র লহ একজন।।
সেই স্থানে গিয়ে এক কৌশল করিব। প্রকারে তে তা সবার জীবন হরিব।।
এই মত পরামর্শ করি সর্ব্বজন। সঙ্গে নিজ বৃদ্ধ দ্বিজ অতীব দুর্জন।!
ভাওয়ালেতে গিয়ে তারা দিল দরশন। জয়স্ত্ত বলিয়ে করে সভাতে গমন।।
(এখানেও ভাওয়াল বলতে বুঝানো হয়েছে “ভাওয়াল “রাজাবাড়ী”- শ্রীপুর, গাজীপুরকে”।)
(সেন বংশের বল্লাল সেন (১০৮৩-১১৭৯) ছিলেন সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা। তার জীবনের শেষ তিন বছর (১১৭৬-১১৭৯) বাংলাদেশের বিক্রমপুরে রাজত্ব করেন। প্রতাপ এবং প্রসন্নের বিরুদ্ধে সম্ভবতঃ ষড়যন্ত্র হয় ১১৭৬-১১৭৯ এর মধ্যে।)
ব্রাহ্মন হেরিয়ে রাজা প্রতাপ প্রসন্ন। ব্রাহ্মনের প্রতি দোহে দেখায় সৌজন্য।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে পুজে ব্রাহ্মনের পদ। ব্রাহ্মনেরা বলে তব বাড়ুক সম্পদ।।
স্বস্তি বানী বলি সবে সবায় বসিল। কেহ নাহি জানে গুপ্ত শত্রু প্রবেশিল।।
বাক্যের প্রবন্ধে যত চাটুকারগন। রাজা প্রতি বলে দাও ব্রাহ্মন ভোজন।!
কল্যান হইবে তব শুন মহাশয়। তোমাদের মত নাহি হেরি সদাশয়।।
চাটুকার বাক্যে চলে ভাই দুইজন। স্বীকার করিল দিতে ব্রাহ্মন ভোজন।।
বৃদ্ধ বিপ্রে রাখি পরে বিদায় মাগিল। বৃদ্ধ বিপ্র কুট জ্বাল ক্রমে বিস্তারিল।।
দুই ভাই নাহি জানে তাহার কারন। অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস বলিয়া ব্রাহ্মন।।
সুযোগ পাইল বিপ্র অতি সঙ্গোপনে। মধুর বাক্যেতে কহে বড় রানী স্থানে।।
(বড় রানী মানে, প্রতাপ এর- স্ত্রী)
শুন মাগো তোমা আমি বড় ভালবাসি। করিতে কল্যান তব আমি হেতা আসি।।
যেন ইহা নাহি জানে কভু ছোট রানী। প্রকারে করিব তোমা রাজার জননী।।
বিপ্রগন সেই দিন আসিবে হেতায়। এক কর্ম কর মাগো সেইত সময়।।
বারিপূর্ন ঝারি নিয়ে করিও ভকতি। বিপ্র বরে তব পুত্র হইলে ভূপতি।।
একযুক্তি দেয় বিপ্র উভয় রানীকে। নিজ নিজ স্বামী পাশে বলেছে কৌতুকে।।
পরে হল সেই দিন আইল ব্রাহ্মন। কুটচক্রে ভাবে কর্ম করিছে সাধন।।
হেনকালে বড় রানী ঝারি নিয়ে হাতে। ঢলিছেন তিনি সেই ব্রাহ্মন সাক্ষাতে।।
ছোট রানী বলে দিদি তুমি যাও কোথা। ব্রাহ্মন বরিতে শুধু মোর আছে কথা।।
এক কথা দুই রানী বলে বারে বার। অস্ত্র হাতে দোঁহার কম্পিত শরীর।।
একে বলে মম নারী একার্য্য করিবে। অন্যে বলে তাহা কভু সঙ্গত নহিবে।।
এই মত বাক্য যুদ্ধ করে দুইজন।ক্রোধেতে তোঁহার অঙ্গ কম্পে ঘনে ঘন।।
কেবল খণ্ডাতে পারে বিধির লিখন। দোঁহার অস্ত্রেতে হয় দোঁহার নিধন।।
করতালি দিয়ে ধায় যতেক ব্রাহ্মন। বলে এতদিনে কর্ম হইল সাধন।।
উপরে উল্লিখিত ব্রাহ্মণ্য ষড়যন্ত্র ঘটনাটি শ্রীযতীন্দ্রমোহন রায়ের “ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থ এসেছে। যা “মতুয়া ধর্মের হরিচাদের পূর্বপুরুষের” ঘটনার সাথে মিলে যায়। “ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থের ৪৭২ পৃষ্ঠায় দেখুন…
“প্রবাদ এই যে, এই ভ্রাতৃদ্বয়ের অত্যাচারে ভাওয়াল প্রায় ব্রাহ্মণ শুন্য হইয়াছিলেন। ভাওয়ালের ব্রাহ্মণগণ প্রতাপ ও প্রসন্ন রায়ের স্পৃষ্ট অন্ন গ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হইলে মদবল দৃপ্ত চন্ডাল ভ্রাতৃ যুগল বলপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে অন্নভোজন করাইতে কৃত সংকল্প হইয়া একদা তাঁহাদিগের রাজ্যস্থিত সমুদয় ব্রাহ্মণগণকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। “ব্রাহ্মণগণ ভোজনে উপবিষ্ট হইলে ভ্রাতৃযুগলের স্ত্রীদ্বয় পরিবেশনার্থ অন্ন পাত্র হস্তে উপস্থিত হইলেন। প্রত্যুৎপন্নমতি জৈনক ব্রাহ্মণ তখন বলিলেন, “আমরা রাজার অন্ন গ্রহণ করিব” কিন্তু উভয় ভ্রাতার মধ্যে সুন্দ উপসুন্দের ন্যায় দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইল। এই গৃহবিবাদের ফলে ভ্রাতৃদ্বয়কে জীবন বিসর্জন দিতে হইয়াছিল। এই প্রবাদের মূলে কোন সত্য নিহিত আছে কিনা তাহা নিশ্চয়রূপে অবধারণ করা কঠিন। তবে ভাওয়াল অঞ্চলে একসময় যে সুব্রাহ্মণের অভাব হইয়াছিল তাহা সম্ভবতঃ সত্য। কেহ কেহ অনুমান করেন প্রতাপ ও প্রসন্ন রায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। বৌদ্ধধর্ম্মের বিনাশের পর তদ্ধাধর্ম্মালম্বী নৃপতিকে বিদ্বেষবশতঃ চন্ডাল বলিয়া অবিহিত করা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রতাপ ও প্রসন্ন রায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন কিনা এবং এই বৌদ্ধধর্ম্মালম্বী নৃপতিদ্বয় কর্তৃক ভাওয়ালের হিন্দুগণ প্রপীড়িত হইয়াছিলেন কিনা এবং তাহাও নির্দ্ধারণ করা শক্ত। প্রতাপ ও প্রসন্ন রায়ের মোগ্গী নান্মী এক ভগীনীর নাম শ্রুত হওয়া যায়। তাহার বাটীর ভগ্নাবশেষ এখন “মোগ্গীর মঠ” নামে খ্যাত হইয়া “চারাল রাজার বাড়ির” পূর্ব্বদিকে বিদ্যমান রহিয়াছে।
এই লেখাগুলি “ঢাকার ইতিহাসের” লেখক শ্রীযতীন্দ্রমোহন রায়- “পূর্ব্ব বঙ্গে পাল রাজাগণ” গ্রন্থ হতে সংগ্রহ করেছিলেন।(পৃষ্ঠা২৪/২৫)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মুগ্গী নাম্মী মহিলাটি মানসিংহের উপপত্নী ছিল। তাদের বোন হবে- ভগবতী। তারপরের পদ…
কুচক্রি ব্রাহ্মন দ্বারা হল এই কর্ম। দুই রানী ক্রমে তার জানিলেক মর্ম।।
পঞ্চম মাস গর্ভবতী ছিল বড় রানী। পতিশোকে দগ্ধীভূতা দিবস যামিনী।।
ক্রমে দশ মাস গত হইল যখন। প্রসবিল এক পুত্র সর্ব্বসুলক্ষন।।
কুমার বলিয়ে নাম রাখিল তাহার। বল্লাল আশ্রিত বিপ্র পায় সমাচার।।
পুনঃ করে কুমন্ত্রনা বধিতে কুমারে। তস্কর পাঠায় এক ভাওয়াল নগরে।।
(আবারও এখানে “ভাওয়াল নগর” বলা হয়েছে। যা “রাজাবাড়ী, শ্রীপুর, গাজীপুরকেই বুঝানো হয়েছে। “রাজাবাড়ি তখন ভাওয়াল নগর ছিলো।”)
প্রানবধ কর তার অতি সুকৌশলে। পাষানে আছাড়ি কিম্বা ফেলিয়া সলিলে।।
এত শুনি যায় তথা শিক্ষিত তস্কর। রাহু যেন চলি যায় গ্রাসিতে ভাস্কর।।
অতি সন্তর্পনে সেই লইল কুমারে। রূপ হেরি স্থির চিত্তে কুমারে নেহারে।।
কুমারে কান্তি হেরি তস্কর ভুলিল। সামান্য না হবে তাহা অন্তরে বুঝিল।।
কুমারে করিয়া কোলে দুরদেশে যায়। পটুকালী গিয়ে শেষে করিল বিক্রয়।।
বনিকেরা মুগ্ধ হয়ে কুমারের রূপে রাখিলেন মহম্মদ ঘোরীর সমীপে।।
(রাজা প্রতাপ এর ছেলে “কুমার” কে নিয়ে গিয়েছিল মুহাম্মদ ঘুরীর প্রসাদে! ঘুরী (১৫ই মার্চ ১১৪৯-১২০৬) পর্যন্ত রাজত্ব করেন। আফগানিস্তানের হিরাত ও গজনির মধ্যবর্তী পর্বতসংকুল স্থানে ঘুরী রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এ রাজ্যের অধিপতিগণ ‘ঘুরী’ নামে খ্যাত।)
পরবর্তী “পদ’গুলিতে লেখা আছে, রামতপা তথা রামদাস এসেছিলেন এই রাজাবাড়ীতে। তিনি সুতপার সর্বকনিষ্ট ভাই ছিলেন। তিনি এসব ঘটনা জেনে খুব ব্যথিত হয়েছিলেন। হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ রামতপা আমাদের এ রাজাবাড়িতে এসেছিলেন এবং তার নামে রাজাবাড়ির পশ্চিম দিকে একটি গ্রাম আছে। -নাম “রাজারামপুর”।
এবার যাচ্ছি আসল জায়গায়- হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের নাম সুতপা। তার অপরনাম ভুসুকুপা-ও হতে পারে! যিনি চর্চাপদের কবি ছিলেন !!
উল্লেখিত হরিচাঁদ জন্মের প্রায় শত বৎসর পরে তারক গোঁসাইয়ের লেখা “হরিলীলামৃত” প্রকাশিত হয়। বলা হয়, তার পূর্বপুরুষ উত্তর বিহারের মিথিলা অঞ্চলের একজন ব্রাহ্মণ সাধু পুরুষ ছিলেন। তার নাম “সুতপা”। তিনি পূর্ববঙ্গে এসে নমঃশূদ্র কন্যার পাণী গ্রহণ করেছিলেন। তারপর থেকে বংশটি নমঃশূদ্র বলে পরিচিত হয়। -এই ঘটনাটির সাথে চর্চাপদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ “পদ” লেখক কবি “ভুসুকুপা”র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার হুবহু মিল আছে।
কে জানে হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ চর্চাপদ কবি “ভুসুকুপা” কিনা ?
এবার চলুন মিলগুলি দেখি…
১) ভুসুকুপা> সুতপা- পদ রচয়িতাদের নামের শেষে পা বা, পাদ যুক্ত করে লেখা হত। চর্যাপদের কবিদের অনেক জায়গায় লুইপা, ভুসুকুপা কুক্কুরীপা, ডোম্বীপা, সরহপা, দারিকপা, কাহ্নুপা, শান্তিপা, কাহ্নপাদ এগুলো লেখা দেখবেন। যারা পদ রচনা করেন তাদের নামের শেষ পাদ বা, পা যুক্ত করা হয়।
২) সুতপা নামটির উৎপত্তি-
ভুসুকুপা’ আসল নাম ছিল “শান্তিদেব। নিজের আবাসে একমনে লেখাপড়া করতেন বলে অন্য ভিক্ষুরা তাকে অলস মনে করত। এজন্য তারা তাকে উপহাস করে ভুসুকু নামে ডাকত। যেখানে, ভু অর্থ ভুক্তি (ভোজন), সু অর্থ সুপ্ত (শয়ন/নিদ্রা), কু অর্থ কুটির ! এখানে সু-অর্থ ‘সুপ্ত”। সুপ্ত থেকে “সুতপা” বা শান্তিদেব হতে “সুতপা” নামটি হতে পারে!
৩) এরা উভয়ে-ই ভীনদেশি ছিলো। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ভুসুকু ভিনদেশী হয়েও বাংলাতে কবিতা লিখেছিলেন। সুতপা এবং ভুসুকুপা কেউই বাঙালি ছিলেননা। হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ সুতপা বিহারের মৈথিলী ব্রাহ্মণ ছিলেন। অন্যদিকে ভুসুকুপা বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালযয়ের শিক্ষক, চর্যাগীতির কবি, অশ্বারোহী সৈনিক, ভিক্ষু ও সিদ্ধ হন।
৪) আমাদের গাজীপুর ও তার আশেপাশের এলাকায় বৌদ্ধ পালশাসন ছিল ৮৫৫ থেকে ৯৮৫ এবং হিন্দু সেনশাসন ৯৮৬ থেকে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়কালের মধ্যেই অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত হয় চর্চাপদ এবং রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। আর ভাওয়াল রাজাবাড়িতে যারা ছিলেন তারা বৌদ্ধ ছিলেন। সুতপা যদি নমঃশূদ্র বিয়ে করে নমঃশূদ্র জাতি তৈরি করেন, তবে ভুসুকুপা চন্ডাল মেয়ে বিয়ে করে বাঙালি হবেন না কেন? উভয়ের ঘটনা তো একই! এ ব্যাপারে আরো কিছু তথ্য দেই…
‘সাপ্তাহিক আজকালে পৃষ্ঠা ১৩, ফেব্র“য়ারী ৪, ২০১১ (সাল)’ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সন্মানিত অতিথি হিসেবে “ভাষা চেতনা বাঙালির গর্বের বিষয়” শীর্ষক ভাষণে বলেন, “যেমন একাদশ শতাব্দীতে চর্যাপদ। এটি বৌদ্ধ ধর্মীয় লেখা। এর মধ্যে ভুসুকু বলে একজন কবি ছিলেন। তিনি পদ্মা দিয়ে যাচ্ছিলেন নৌকাতে। পথে তার যাবতীয় সম্পত্তি ডাকাতরা নিয়ে যায়, তাকে মারধর করে। তারপর তিনি লিখছেন, নিজেকে নিয়েই যে, ভুসুকু তোমার সব সম্পত্তি ডাকাত নিয়ে গেছে। আমি (অর্মত্য সেন) সে যুগের বাংলা থেকে এ যুগের বাংলা করছি। তিনি (ভুসুকু)বলছেন তোমার সব সম্পত্তি নিয়ে গিয়ে তোমাকে ডাকাতরা মুক্তি দিয়েছে। তুমি এখানেই থেকে জাত বিচার বাদ দিয়ে একটি চন্ডাল মেয়ে বিয়ে করে পরিবার প্রতিষ্ঠা করো। তারপর বলেছেন যে, তুমি সব হারিয়ে সত্যি বাঙালি হলে।”
তদানিন্তন ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে মহাকবি ভুসুকু অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে বলেছিলেন, “আমি আজ বাঙালি হয়ে ‘অহং’ কে জয় করে সিদ্ধপুরুষ হয়েছি।” বৌদ্ধ পালি ভাষায় যার নাম ‘সউপাধিশেষ নির্বান লাভ’ বা রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে পরমার্থ জীবন ।চর্যাপদের উক্ত ৪৯ নম্বর কবিতায় এবং পরম শ্রদ্ধেয় কবি ভুসুকু লিখেছিলেন, “বজ্রনৌকা পাড়ি দিয়ে পদ্মানদীতে গেলাম। নির্দয় দস্যু দেশ লুট করে নিয়ে গেল। নিজের গৃহিনীকে (কামতৃষ্ণাকে) চন্ডালে নিয়ে যাবার পর ভুসুকু আজ তুমি বাঙালি হলে। পঞ্চপাটন (৫ উপাদান স্কন্ধ) দগ্ধ, ইন্দ্রিয়ের বিষয় বিনষ্ঠ। জানি না আমার চিত্ত কোথায় গিয়া প্রবেশ করলো। আমার সোনা রুপা কিছুই থাকলো না, নিজের পরিবারে মহাসুখে থাকলুম। আমার চৌকোটি ভান্ডার নিঃশেষ হলো, জীবনে মরণে আর ভেদ নেই।” আলোচ্যমান চর্যায় কবি ভুসুকু কামতৃষ্ণা বা বিয়ে করার ইচ্ছাকে গৃহিনী বলেছেন, “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী (আজ বাঙালির ইতিহাসে ভুসুকু কামতৃষ্ণাকে জয় করে সিদ্ধপুরুষ বা বাঙালি হল), নিঅ (নিজ) ঘরিনী (কাম তৃষ্ণার লোভ লালশা বা গৃহিনী) চন্ডাল লেলী (চন্ডালে নিয়ে গেল)।”
এবার সুতপা’র নমঃশূদ্র বিয়ের ব্যপারে বলা হয়ে থাকে- হরিচাঁদ ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভুত।তার পূর্বপুরুষ(সুতপা) উত্তর বিহারের মিথিলা অঞ্চলের একজন ব্রাহ্মণ সাধু পুরুষ ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গে এসে নমঃশূদ্র কন্যার পাণী গ্রহণ করেছিলেন। তারপর থেকে বংশটি নমঃশূদ্র বলে পরিচিত হয়।
এখন উপরের সব কয়টি বিষয়কে যদি একত্র করি তবে দেখতে পাব ভুসুকুপা এবং সুতপার জীবনবৃত্তান্ত- প্রায় একই। শুধু একজন বৌদ্ধভিক্ষু, সিদ্ধ পুরুষ অন্যজন- ব্রাহ্মণ। তারা উভয়ে পূর্ববঙ্গে এসে চন্ডাল/নমঃশূদ্র মেয়ে বিয়ে করেন। নমঃশূদ্র শব্দটি ১৮৮০ সালের আগে “চন্ডাল” ছিল। তাই উভয়ই চন্ডাল বিয়ে করেছিলেন।
৫) উভয়ের জীবনকাল প্রায় একই রকম। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, শান্তিদেব ভুসুকু সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ভুসুকুর জীবিৎকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিস্টাব্দ। ধর্ম পালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮০৬ খ্রিস্টাব্দ) ভুসুকু জীবিত ছিলেন। সেই মতে, সুতপা-ও নবম শতাব্দীর লোক।
৬) সুতপা এবং ভুসুকুপা- উভয়েরই ভাষা ছিল “মৈথিলী”। বহু পন্ডিত চর্যাপদের ভাষার সাথে অসমিয়া, ওড়িয়া, বাংলা ও মৈথিলী ভাষার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন।
৭) হরিচাঁদের জীবনীতে উল্লেখিত আছে যে, সুতপা ভাওয়াল নগর এসেছিলেন। এখানেই তার পুত্র জয়দেব, এবং তার নাতি নাতনী- ভগবতী, প্রতাপ ও প্রসন্নদের রেখে যান। যদি সুতপা’র সাথে ভুসুকুপা’র জীবনী একাত্ব হয় তবে সুতপাই> ভুসুকুর সুরে আমাদের ভাওয়াল গাজীপুরের শ্রীপুরের পারুলী নদীর তীরে বসে নিজেকে বাঙালী ঘোষণা দিয়ে বলছেন…
“বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।”
আধুনিক বাংলায়ঃ “ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল”।
এখানে “বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ (“বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া “পদ্মার খাল” বাহিলাম। ভুসুকাপা’র এই পদে “পদ্মা”কে “খাল” বলেছেন। তার “পঁউআ খাঁল” শব্দটি পারুলি খাল নদীর সাথেই মানানসই, পদ্মার সাথে নয়। কেননা,পদ্মা- বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধ্বংসাত্মক স্রোতস্বিনী নদী যা কখনো খাল হতে পারে না। ভুসুকুপা’র মত পন্ডিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সিদ্ধপুরুষ পদ্মা “নদী”কে কখনো “খাল” বলে ভুল করতে পারেন না। কিন্তু পারুলী ঠিকই খালের ন্যায়! ভুসুকু বর্ণিত “পঁউআ খাঁল” শব্দদ্বয় পারুলী নদীর সাথে সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত। খালের ন্যায় পারুলী নদী সম্পর্কে উইকিতে আছে, “নদীটির দৈর্ঘ্য ২৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৫২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক পারুলী খাল নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ৩৪। দৈর্ঘ্য: ২৩ কিলোমিটার (১৪ মাইল)। মোহনা: বালু নদী। দেশ: বাংলাদেশ।” – এখানে পারুলী নদীকে “খাল নদীর” পর্যায়ে ফেলা হয়েছে। নদীটি তৎকালীন বরমীবাজারের মাটিয়াগারা গ্রাম হতে বালু নদীর দিকে বেলাই বিলে পতিত হয়েছে। অর্থাৎ এই নদীটি খালের ন্যায়। এই নদীর তীরে তখন ছিলো চন্ডাল অধ্যুষিত এলাকা। দেশভাগের পর অধিকাংশ নমঃশূদ্র/চন্ডাল পশ্চিমবঙ্গের চলে যাওয়ার পরেও এখনো এলাকাটিতে প্রচুর নমঃশূদ্র আছে।
এখন উপরে উল্লেখিত চরিত্রদু’টি পর্যালোচনা করে এটা সিদ্ধান্তে আসা যায় সেটা হল- যিনি সুতপা তিনিই ভুসুকুপা! শুধুমাত্র স্থান ও কালের সাপেক্ষে, বুদ্ধিমান কোন পাত্রের হাতে পড়ে, বৌদ্ধ ভুসুকুপা- হিন্দু সুতপা ব্রাহ্মণ্য চরিত্রে পরিবর্তিত হয়েছে! মানে ভুসুকুপা হয়ে গেছে সুতপা!
৮) এবার ভুসুকুর পরিচয় : চর্যাগীতি রচনার সংখ্যাধিক্যে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলেন ভুসুক পা। তাঁর রচিত আটটি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে সংগৃহীত হয়েছে। তাঁর প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি সৌরাষ্ট্রের রাজপুত্র ছিলেন এবং শেষ জীবনে নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে নিঃসঙ্গ ভাবে অবস্থান করেন। সেজন্য ভুক্তির ভু, সুপ্তির সু এবং কুটিরের কু -এই তিন আদ্যাক্ষর যোগে তাঁকে ভুসুক বলে পরিহাস করা হত। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে শান্তিদেব ভুসুক সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে ভুসুকুর জীবিৎকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিস্টাব্দ। ধর্ম পালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮০৬ খ্রিস্টাব্দ) ভুসুকু জীবিত ছিলেন। তিনি রাউত বা অশ্বারোহী সৈনিক ছিলেন। পরে ভিক্ষু ও সিদ্ধ হন। (উইকিপিডিয়া)
এখন আমার কথা হল, যিনি সৌররাষ্ট্রের রাজপুত্র এবং চৌকস অশ্বারোহী তিনি যে কোন জায়গায় গিয়ে তিনি কিংবা তার বংশধর রাজ্য অধিকার শাসন করতে পারেন। সেই হিসেবে বলা যায়, সুতপা যদি ভুসুকু হন তবে তিনি আমাদের রাজাবাড়িতে রাজ্য পরিচালনায় অংশ নিয়ে থাকতে পারেন। তার ছেলে জয়দেব এবং পরবর্তী প্রতাপ প্রসন্ন স্বাভাবিকভাবেই রাজবাড়ির রাজা হতে পারেন। ব্রাহ্মণরা রাজাদের চন্ডাল বলতো সে কথা তো আগেই বলেছি অর্থাৎ প্রতাপ ও প্রসন্ন বৌদ্ধধর্মের সামন্ত রাজা ছিলেন সেই জন্য তাদেরকে “চন্ডাল” রাজা বলা হত।
৯) এবার আসি, ইতিহাসের সন, তারিখ নিয়ে…
লেখক ও গবেষক আমিনুল হক সাদী জানান, মুসলিম শাসনপূর্ব সময়ে ঢাকা ও পাশের এলাকায় পাল (৮৫৫-৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) ও সেন (৯৮৬-১২০৩ খ্রিষ্টাব্দ) বংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। সে হিসেবে বলা যায় সেনবংশের বৌদ্ধ নিধনের সময়কালে ( ৯৮৬-১২০৩ খ্রিষ্টাব্দ) ভাসুকুপা’র রচিত চর্যাপদ এর কাহিনী রাজাবাড়ি শ্রীপুর গাজিপুর হতে নেপালে চলে যায়।
অতএব, পাঠক আপনারাই বলেন, হরিচাঁদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বৌদ্ধধর্মীয় চর্যাপদের বিখ্যাত কবি ভুসুকুপার বংশধর এবং তাদের বসতভিটা ছিলো আমাদের ভাওয়াল গাজীপুর জেলার রাজাবাড়ি নামক চিনাশুখানিয়া গ্রামে চন্ডালরাজার বাড়িতে?!
– কি বিশ্বাস হচ্ছেনা ? না- বিষয়টা আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। কেননা, হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ এর জীবনী যিনি লিখেছিলেন তিনি সেই ইতিহাস কোথা থেকে নিয়েছিলেন, সেটা আদি ও আসল কিনা তার ওপর নির্ভর করছে আমার এই অনুমান ও যুক্তি। তার পরেই কেবল প্রমাণ করা যাবে সত্যিকারের ভুসুকুপা আমাদের ভাওয়াল রাজাবাড়িতেই বসে লিখেছিলেন বাঙালির আদি নিদর্শন”চর্যাপদ”!
লেখক : জাকির হোসেন, রাজেন্দ্রপুর, শ্রীপুর, গাজীপুর।
আপনার মতামত জানানঃ