চল্লিশ হাজার বছর আগে ইউরোপে আমরাই একমাত্র মানব প্রজাতি ছিলাম না। আরও তিন প্রজাতির বাস ছিলো তখন। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে তারা বাস করত। আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তারা।
ফসিল রেকর্ড অনুসারে এটা নিশ্চিত যে, ২৮,০০০ বছর পূর্বে তাদের শেষ আস্তানা থেকেও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো নিয়ানডার্থালরা। শেষ আস্তানা ছিলো জিব্রাল্টার, আইবেরীয় উপদ্বীপের শেষ প্রান্তে অবস্থিত বর্তমান ব্রিটেন সরকার শাসিত অঞ্চল। বর্তমান স্পেন, পর্তুগাল, অ্যান্ডোরা এবং জিব্রাল্টার অঞ্চলগুলো নিয়েই আইবেরীয় উপদ্বীপ। এখানকার অপেক্ষাকৃত সহনশীল জলবায়ু এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিচিত্র সমাহারই বোধহয় নিয়ানডার্থালদের টেনেছিলো।
নিয়ান্ডাথালদের উদ্ভব
প্রথম ১৮২৯ সালে বেলজিয়ামের এঞ্জিসের কাছাকাছি গুহা থেকে একটি নিয়ান্ডারথাল শিশুর মাথার খুলি আবিষ্কার করা হয়। তারপর থেকে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ফসিল পাওয়া গেছে যা কয়েকশো নিয়ান্ডারথাল ব্যক্তির অবশেষের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মধ্যে বাচ্চা, শিশু এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কর ফসিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নিয়ান্ডাথালদের বিকাশ ঘটেছিলো ইউরোপ এবং এশিয়াতে। পক্ষান্তরে বর্তমান মানুষের প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিলো আফ্রিকাতে। ফসিল গবেষণা করে বিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা দেখেছেন যে, নিয়ান্ডারথালদের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ বছর আগে ইউরোপে। এই প্রজাতিটি ইউরেশিয়া, পশ্চিম পর্তুগাল এবং ওয়েলস থেকে সাইবেরিয়ার আলটাই পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
চল্লিশ হাজার বছর আগে ইউরোপে আমরাই একমাত্র মানব প্রজাতি ছিলো না। আরও তিন প্রজাতির বাস ছিলো তখন। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে তারা বাস করত। আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তারা।
জিব্রাল্টারে নিয়ান্ডারথালদের কিছু বসতি ছিল। সেখানকার আইবেরিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট বিশ্লেষণে জানা গেছে, আধুনিক মানুষের চেয়েও বনভূমির পরিবেশে ভালো শিকারি হিসেবে অভিযোজিত নিয়ান্ডারথালরা গরম কাপড় পরতো, ভয়ঙ্কর শিকারি ছিল এবং তাদের অত্যাধুনিক পাথরের হাতিয়ার ছিল। তাদের অস্ত্র বড় প্রাণী শিকারের উপযুক্ত ছিল। এমনকি চকমকি পাথরে কুঠার তৈরি করে খরগোশের মতো ছোট প্রাণীও শিকার করতে পারতো তারা। মৃত পশুর মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ দিয়ে উড়ন্ত পাখি শিকারের মতো বুদ্ধিও অর্জন করেছিল। নিয়ান্ডারথালরা ছিলো অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন। ঠাণ্ডা জলবায়ু সত্ত্বেও কয়েক লাখ বছর ধরে সফলভাবে বসবাস করেছিলো তারা। নিয়ানডার্থালদের উদ্ভব ঘটেছিলো শেষ তুষার যুগ শুরু হওয়ার পর, আবার বিলুপ্তিও ঘটেছে সেই তুষার যুগ শেষ হওয়ার আগে। তার মানে পুরোটা সময় তারা খুব শীতল পরিবেশে জীবন যাপন করেছে। এই শীতল পরিবেশের সাথে অভিযোজনই সম্ভবত তাদের ভারিক্কি শরীরের বিবর্তনের কারণ।
ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২ লক্ষ বছর যাবৎ নিয়ানডার্থালরা রাজত্ব করেছে। আনুমানিক ১ লক্ষ বছর পূর্বে আদিম-আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। ৪০ থেকে ৫০ হাজার বছর পূর্বে তাদের সাথে দেখা হয় নিয়ানডার্থালদের। ভাবতেই অবাক লাগে পৃথিবীর বুকেই আমাদের মত বুদ্ধিমান আরেকটি প্রজাতির সাথে আমরা একসাথে প্রায় ৩০,০০০ বছর পার করেছিলোাম।
কেমন দেখতে ছিলো নিয়ান্ডারথালরা?
নিয়ান্ডারথালদের মাথার খুলি ছিলো লম্বা এবং নিচু। তাদের ভ্রু ছিলো ধনুকাকৃতির। মুখটা সামনের দিকে একটু বেশিই প্রসারিত ছিলোো। নাক ছিলো লম্বা এবং প্রশস্ত। নিয়ানডারথালদের বক্ষপিঞ্জর অনেক চওড়া ও বড়, কাঁধ চওড়া, নিতম্ব চওড়া, হাড়গুলো মোটা মোটা। তাদের মস্তিষ্কের আয়তন গড়ে আমাদের চেয়ে বেশি ছিলো, এসবের কারণ শীতল পরিবেশ হতে পারে। শীতল পরিবেশে উচ্চ মাত্রার বিপাক ক্রিয়ার জন্য বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজন পড়ে।
তাদের সামনের দাঁত অনেক বড় ছিলোো এবং তাতে ছিলোো নানা দাগের চিহ্ন। তারা যখন খাবার বা অন্যান্য উপকরণ তৈরি করতো তখন তাদের লম্বা দাঁতগুলো তৃতীয় হাতের কাজ করতো। নিয়ান্ডারথালদের শক্ত পেশীবহুল দেহ ছিলোো। পূর্ণবয়স্ক নিয়ান্ডারথালরা ১.৫০ থেকে ১.৭৫ মিটার লম্বা হতো এবং ওজন হতো ৬৪-৮২ কেজি।
নিয়ান্ডারথাল নারীদের স্তনের আকার অনেক বড় ছিলো। কারণ দ্রুত মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রচুর মাতৃদুগ্ধ প্রয়োজন হতো। ছোট হাত এবং পা নিয়ে তাদের শরীর ছিলো গাট্টাগোট্টা ধরনের। এ ধরনের শরীর ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত ছিলো।
যা খেতো নিয়ান্ডারথালরা
খুবই ঠান্ডা পরিবেশে থাকলেও তারা শিকারে খুবই পারদর্শী ছিলো। বিভিন্ন প্রাণী শিকার করে খেতো তারা। মূলত মাংশাসী হলেও তাদের দাঁতে লেগে থাকা বিভিন্ন লতাপাতার উপস্থিতি প্রমাণ করে যে তারা লতাপাতাও খেতো। হয়তো এ লতাপাতা তারা নিজেরাই সংগ্রহ করতো অথবা তারা যে তৃণভোজী প্রাণীদের মাংস খেতো তাদের পেটের মধ্যকার পাতা। এছাড়া তারা বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাকও খেতো।
নদী, সমুদ্র থেকেও খাবার সংগ্রহ করতো নিয়ান্ডারথালারা। তারা ঝিনুক, সিল মাছ এবং ডলফিনও খেতো। এসব সিল বা ডলফিন সরাসরি শিকার করতে না পারলেও মৃত সিল বা ডলফিনের মাংস খেত তারা।
জিব্রাল্টারের ভ্যানগার্ড গুহা থেকে সিল মাছের চোয়াল উদ্ধার করা হয়। গবেষকরা সে চোয়াল গবেষণা করে দেখেছেন যে নিয়ান্ডারথালরা খাবারের জন্য সমুদ্রের প্রাণীদের উপরও নির্ভরশীল ছিলো। যদিও নিয়ান্ডারথালরা আগুন জ্বালাতে জানতো, তবুও তারা প্রতিদিন তাদের খাবার রান্না করে খেতো কি না সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হয়নি এখনও।
নিয়ান্ডারথালরা কি কথা বলতে পারতো?
নিয়ান্ডারথালরা কথা বলতে পারতো কি না সেটি নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। কারন কথা বলার জন্য স্বরযন্ত্রে যে টিস্যু থাকে নিয়ান্ডারথালদের সে টিস্যু সংরক্ষণ করা যায়নি। তবে মুখের গঠন এবং কানের হাড় ধারণা দেয় যে আধুনিক মানুষের মতো তারা শ্রবণে সক্ষম ছিলোো।
বর্তমান সময়ে এসে গবেষকরা দেখেছেন যে, তাদের সামাজিক জীবন খুবই জটিল ছিলো এবং নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে পারতো। তবে তাদের ভাষা ছিলো একেবারেই সাদামাটা ধরনের।
ভাষার ব্যাপারে অনেকদিন আমরা নিয়ানডার্থালদের অবজ্ঞা করেই চলেছি। কিন্তু ইসরায়েলের কেবারা গুহা থেকে পাওয়া ‘কেবারা ২’ নামের ফসিলটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। এ থেকে জানা গেছে, নিয়ানডার্থালদের জিহ্বার গোড়ায় অবস্থিত হাইঅয়েড অস্থির গড়ন আমাদের মতোই এবং মুখ এবং বাগযন্ত্রে এমন কোন সীমাবদ্ধতাই নেই যা বাকশক্তিতে বাঁধার সৃষ্টি করতে পারে। তার মানে দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে ঠিক আমাদের মতো করে কথা বলায় কোনই অসুবিধা ছিলো না তাদের।
এ তো গেল অ্যানাটমির কথা। ২০০৭ সালে জিন পর্যায়েও বাকশক্তির পক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর এভল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি-র বিজ্ঞানী ইয়োহানেস ক্রাউস নিয়ানডার্থাল ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, যে জিন এর কারণে আমরা কথা বলতে পারি সেই একই জিন তাদের মধ্যেও রয়েছে, জিনটির নাম ফক্সপি২ (FOXP2 – Forkhead box protein P2)।
নিয়ান্ডারথালদের ঘর গৃহস্থালি
দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো মানুষ প্রথম ঘর গোছানো শুরু করে আধুনিক মানুষের হাত ধরে। তাদের পূর্বপুরুষ নিয়ান্ডারথালেরা তেমন গোছানো ছিলো না। শিকার এবং খাওয়ার পর বাসস্থান অবিন্যস্ত রাখাই ছিলো চিন্তার বিষয়। বহু দিনের এই ধারণা ভেঙে গেল সাম্প্রতিক এক আবিষ্কারে।
উত্তর পশ্চিম ইতালির এক গুহায় খননকার্য চালাতে গিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা দেখেছেন সেখানকার এক সময়ের আবাসিক নিয়ান্ডারথালেরা গুহাটিকে রীতিমতো তিনটি প্রকোষ্ঠে ভাগ করে বসবাস করতো। একটিতে শিকার করা পশুদের মাংস কেটে খাওয়ার উপযোগী করা হতো। গুহার পিছনের দিকের অংশটি ব্যবহৃত হতো রান্নাঘর হিসাবে। সেখানে একটি বিশালাকায় চুল্লির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে শোবার ঘর হিসাবে গুহার উপরের অংশই পছন্দ ছিলো নিয়ান্ডারথালদের।
হিংস্র পশু বা বহিরাগত আক্রমণ থেকে বাঁচতে গুহার উপরের অংশের ব্যবহার যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় বলেই মতো বিশেষজ্ঞদের। গুহার নীচের দিকের অংশ তারা ব্যবহার করতো অস্থায়ী ক্যাম্প হিসাবে। এই অস্থায়ী ক্যাম্পের ব্যবহারই ভবিষ্যতের বৈঠকখানার বীজ কি না তা অবশ্য জানা যায়নি।
গুহার একটু ভিতরের দিকে যেখানে সূর্যের আলো আসতো, সেখানে পাথরের যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্রের খোঁজও মিলেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সেই যুগেই সাধারণ যন্ত্র তৈরিতে যথেষ্ট পটু ছিলো নিয়ান্ডারথালরা।
নিয়ান্ডারথালদের হিংস্রতা
একসময় নিয়ান্ডারথালরা মধ্যে নিজ প্রজাতির মাংস খেত। তার প্রমাণ মিলেছে বেলজিয়ামের গোয়েত গুহা থেকে প্রাপ্ত মানুষের হাড়ে। গবেষকরা সেই গুহা থেকে ৪০ হাজার বছর আগের যে হাড় পেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে সদ্যোজাত বাচ্চা, শিশু, তরুণ এবং বয়স্ক মানুষের হাড়।
এসব হাড় বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, নিয়ান্ডারথালরা নিজ প্রজাতির মাংস খেতো। এই হাড়গুলো ঠিক সেই সময়ের যে সময় নিয়ান্ডারথালরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে এবং হোমো স্যাপিয়েন্সরা (বর্তমান মানুষ) তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, নিয়ান্ডারথালরা বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলোো। ধ্বংসের পথে এসেও তারা তাদের মৃতদেহের দেখভাল করতো এবং দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতো। কিন্তু মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকলে তারা মৃতদেহে খেয়ে ফেলতে শুরু করে।
এ বিষয়ে গবেষক ক্রিস্টিয়ান ক্যাসিয়াস বলেন, হাড়গুলোতে কেটে ফেলার চিহ্ন রয়েছে। সে হাড় থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। নিয়ান্ডারথালরা হাড়গুলো এমনভাবে ভেঙেছে যেভাবে তারা ঘোড়া এবং হরিণের হাড় ভাঙতো। এমনভাবে মাংস বিচ্ছিন্ন করেছে যেভাবে ঘোড়া এবং হরিণের মাংসা বিচ্ছিন্ন করতো হাড় থেকে। কিন্তু তারা ঠিক কী কারণে নিজেদের মাংস খেতো সেটা এখনো রহস্যের বিষয়।
নিয়ান্ডারথালের সঙ্গে আধুনিক মানুষের যৌন মিলন
গবেষণায় জানা যায়, নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলো আধুনিক সভ্য মানুষ। তাদের উভয়ের মিলনের এমন ঘটনা ঘটেছিলো আজ থেকে প্রায় ১ লাখ বছর আগে।
গবেষকরা বলছেন, নিয়ান্ডারথালের সঙ্গে আধুনিক মানুষের যৌন মিলনের ফলে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হয় আধুনিক মানুষের ডিএনএতে। আর এটি আধুনিক মানুষের বিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো।
নিয়ান্ডারথালরা প্রজননের দিক দিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে পিছিয়ে ছিলো। ফলে নিয়ান্ডারথালদের তুলনায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নিয়ান্ডারথালরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে পিছিয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ডিএনএ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। তারপরই আদিম মানুষের সঙ্গে সেক্সের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হন গবেষকরা। আফ্রিকা থেকে আধুনিক সভ্য মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ঘটেছিলো এ ঘটনা।এর আগেও আদিম মানুষের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালের মিলনের বিষয়টি গবেষণায় উঠে এসেছিলো। তখন ভাবা হয়েছিলো ৪৭,০০০ থেকে ৬৫,০০০ হাজার বছর আগে এমনটা হয়েছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে সে ভাবনা ভুল। এ সময়কালটি ছিলো প্রায় এক লাখ বছর আগে।
বিজ্ঞানীদের মতে, নিয়ান্ডারথালের সঙ্গে যৌনমিলনের প্রভাব মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে স্পষ্ট ছাপ রেখে যায়। ধারণা করা হয়, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ তটরেখা ধরে লোহিত সাগর অতিক্রম করে আরব উপদ্বীপে এসে পৌঁছেছিলো।
কিন্তু ম্যানটের খুলি পরীক্ষা করে বোঝা যাচ্ছে, পূর্ব আফ্রিকার আদি বাসস্থান ছেড়ে উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করে তারা। এরপর নুবিয়ার মরুভূমিতে পৌঁছে তারা সিনাই উপদ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখান থেকে তাদের যাত্রাপথ ইসরায়েলে গিয়ে পৌঁছায়।
নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তি
আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় নিয়ান্ডারথালরা। যদিও আধুনিক অনেক মানুষের মধ্যেও তাদের ডিএনএ রয়ে গেছে। নিয়ান্ডারথালরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এটি একটি জানা ঘটনা, কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বছর বেঁচে থাকার পরও তারা কেন এবং কীভাবে বিলুপ্ত হলো সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের বিলুপ্তির সঠিক কারণ এখনো অজানা। তবে তাদের বিলুপ্তি নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, তাদের বিলুপ্তির পেছনে আমরা আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষরাই দায়ী। শুরুর দিকের আধুনিক মানুষরা ৪০ বা ৬০ হাজার বছর আগে ইউরোপে আবির্ভূত হতে থাকে। সে সময় হোমো স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা সহাবস্থানই করতো। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্সরা তাদের বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে প্রতীকী শিল্পকর্মে উন্নত হতে থাকে। এর ফলে নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো স্যাপিয়েন্সদের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা।
এর মধ্যে নিয়ান্ডারথালরা প্রজননের দিক দিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে পিছিয়ে ছিলো। ফলে নিয়ান্ডারথালদের তুলনায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নিয়ান্ডারথালরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে পিছিয়ে পড়ে। তাছাড়া হোমো স্যাপিয়েন্সরা তাদের আবাসস্থল দখল করতে শুরু করে। এর ফলে নিয়ান্ডারথালরা বাস্তুচ্যূত হতে থাকে। তবে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন জেনেটিক্যালি নিয়ান্ডারথালরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে দুর্বল ছিলোো। এর ফলে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি নিয়ান্ডারথালরা।
অনেকেই আবার নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির পেছনে বিরূপ আবহাওয়াকে দায়ী করেন। নিয়ান্ডারালদের প্রায়শই বিরুপ আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তারা যে সময়ে যে স্থানে বাস করতো তা ছিলো খুবই ঠান্ডা। তবে ধীরে ধীরে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্রমশ আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে থাকার কারণে তারা অভিযোজন করতে অক্ষম হতে শুরু করে। বিরুপ আবহাওয়ার ফলে ১ লক্ষ বছর আগের সময়ে নিয়ান্ডারথালরা খন্ড খন্ড দল উপদলে ভাগ হয়ে যায়। ফলে নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে বংশবৃদ্ধির মাত্রাও অনেকটা কমে যায়। এ কারণেই তাদের সংখ্যাও কমতে থাকে। তবে তাদের সবার বিলুপ্তি একই সাথে ঘটেনি। ধীরে ধীরে তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে।
এজন্য অনেক গবেষকই মনে করেন দ্রুত পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে না পারার কারণে এবং বিরূপ আবহাওয়ায় নিয়ান্ডারথালদের খাবারের ঘাটতির কারণে তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৪
আপনার মতামত জানানঃ