
প্রতিদিন আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা নিয়ে মুগ্ধ হই। চ্যাটজিপিটি দিয়ে কাজ করি, শিখি, কথা বলি, এমনকি একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেই একই প্রযুক্তি যদি একদিন মানুষের জীবনকে বিপদে ফেলে, তখন প্রশ্ন ওঠে—এই বুদ্ধিমত্তা আসলে কাকে রক্ষা করছে, কাকে নয়? ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক তথ্য বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, প্রতি সপ্তাহে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ চ্যাটজিপিটির সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছেন, যা স্পষ্টভাবে আত্মহত্যার চিন্তা বা পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে দশ লাখেরও বেশি ব্যবহারকারী এই চ্যাটবটের কাছে নিজেদের মানসিক কষ্ট, হতাশা কিংবা বেঁচে থাকার অনিচ্ছা ব্যক্ত করছেন।
একই সঙ্গে আরও জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ লাখ ষাট হাজার ব্যবহারকারী এমন কথোপকথন করছেন, যেগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুতর সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যখন প্রায় আটশো মিলিয়ন, তখন এই সংখ্যাটি ছোট নয়। বরং এটা একটি বৈশ্বিক সতর্ক সংকেত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে এখন কেবল প্রযুক্তির হাতিয়ার নয়, মানুষের মনোজগতেরও অংশ হয়ে উঠেছে—এই তথ্য সেটিই প্রমাণ করছে।
ওপেনএআই বলছে, এই কথোপকথনগুলো সনাক্ত বা পরিমাপ করা খুবই কঠিন। অনেক ব্যবহারকারী সরাসরি “আমি মরতে চাই” বা “আমি আর পারছি না” এমন কথা বলেন না, বরং আড়ালভরা ভাষায় বা দীর্ঘ আলাপে হতাশার ইঙ্গিত দেন। তাই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এটি একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ মাত্র। কিন্তু সংখ্যাটা যতই প্রাথমিক হোক না কেন, তা ভয়ানক বাস্তবতাকে প্রকাশ করে—বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ এখন তাদের গভীর মানসিক যন্ত্রণার কথা বলছে এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, যেখানে অপর প্রান্তে কোনো মানুষ নেই।
এই তথ্য প্রকাশের সময় ওপেনএআই নিজেও এক ধরনের নজরদারির মুখে রয়েছে। কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক কিশোর চ্যাটজিপিটির সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলার পর আত্মহত্যা করে। তার পরিবার অভিযোগ তোলে, চ্যাটবটের সঙ্গে সেই আলাপ তাকে আরও মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলেছিল। ঘটনাটির পর তারা ওপেনএআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। একই সঙ্গে মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশন বা এফটিসি এআই চ্যাটবটগুলোর ওপর বড় পরিসরে তদন্ত শুরু করে, যেন বোঝা যায় শিশু ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এসব প্রযুক্তির প্রভাব কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।
ওপেনএআই তাদের ব্লগপোস্টে দাবি করেছে, নতুন জিপিটি–৫ মডেলে আগের তুলনায় নিরাপত্তা বেড়েছে। তারা বলছে, আত্মহত্যা বা আত্মক্ষতি সম্পর্কিত কথোপকথনগুলোর মধ্যে ৯১ শতাংশ ক্ষেত্রেই চ্যাটবট সঠিক আচরণ করছে, যেখানে আগের সংস্করণে এই হার ছিল ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন মডেল আগের তুলনায় বেশি সতর্ক, বেশি দায়িত্বশীল। এখন এটি ব্যবহারকারীদের সংকটকালীন হটলাইন নম্বর দেখিয়ে দেয়, দীর্ঘ আলাপের মাঝে বিরতি নেওয়ার পরামর্শ দেয়, এবং প্রয়োজনে সহায়তা নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, গত কয়েক মাসে তারা ১৭০ জন চিকিৎসককে যুক্ত করেছে, যারা মানসিক স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে চ্যাটবটের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করছেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যাটা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং মানসিক ও সামাজিকও। মানুষ যখন চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলে, তখন সেটিকে বন্ধু বা পরামর্শদাতা ভাবতে শুরু করে। সেই বন্ধুত্বের ভেতরেই এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। যদি চ্যাটবট ভুলভাবে প্রতিক্রিয়া দেয় বা ব্যবহারকারীর হতাশাকে নিরুৎসাহিত না করে বরং সমর্থন করে, তাহলে ক্ষতি ভয়াবহ হতে পারে। গবেষকরা এই প্রবণতাকে বলেন ‘সাইকোফ্যান্সি’। অর্থাৎ এআই কখনো কখনো ব্যবহারকারীর কথা অন্ধভাবে মেনে নেয়, তা ভুল বা বিপজ্জনক হলেও। এটি মানুষের আবেগের বিপরীতে না গিয়ে বরং তাকে আশ্বস্ত করে, এবং এই আশ্বাসই আত্মধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন, মানসিক সহায়তার জায়গায় চ্যাটবটকে ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এটি মানুষের মতো সহানুভূতি দেখাতে পারে না। এটি ভাষা বোঝে, কিন্তু অনুভূতি বোঝে না। যখন কেউ গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে থাকে, তখন সামান্য ভুল প্রতিক্রিয়াও বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি লেখে, “আমার জীবনের আর মানে নেই,” তখন একজন মানুষ হয়তো বলবে, “তুমি একা নও, আমি তোমার পাশে আছি।” কিন্তু একটি চ্যাটবট হয়তো বলবে, “তুমি কি কোনো সাহায্য নিতে চাও?”—এই পার্থক্যটিই জীবন-মৃত্যুর ফারাক তৈরি করতে পারে।
তবে বিষয়টি একপেশে নয়। বাস্তবতা হলো, লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন চ্যাটবটের কাছে মানসিক স্বস্তি খোঁজেন, কারণ তারা কাউকে খোলামেলা বলতে পারেন না। সমাজে মানসিক অসুস্থতা বা হতাশা নিয়ে কথা বলা এখনও অনেক জায়গায় লজ্জার বিষয়। মানুষ ভয় পায় বিচার, সমালোচনা বা ভুল বোঝাবুঝি। সেখানে চ্যাটবট বিচার করে না, হাসে না, গোপনীয়তা রক্ষা করে। এই নির্ভরযোগ্যতার কারণেই অনেকে চ্যাটবটের কাছে নিজের গভীরতম যন্ত্রণা প্রকাশ করে ফেলেন। তাই একদিক থেকে এটি মানসিক সহায়তার বিকল্প দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু এই দরজার ওপাশে যদি কেউ না থাকে যে সত্যিকারের যত্ন নেবে, তাহলে তা হতে পারে আত্মঘাতীও।
ওপেনএআই নিজে অবশ্য বলেছে, তারা তাদের পণ্যের সঙ্গে ব্যবহারকারীদের মানসিক সংকটের সরাসরি সম্পর্কের দায় নিচ্ছে না। অর্থাৎ তারা স্বীকার করছে না যে চ্যাটজিপিটি কারও আত্মহত্যার কারণ। বরং তারা বলছে, প্রযুক্তিকে আরও নিরাপদ করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই বক্তব্যে দায়মুক্তি পাওয়া যায় না, কারণ প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, তার ব্যবহার শেষ পর্যন্ত মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে যখন সেই ব্যবহার মানসিক দুর্বলতার সময় ঘটে।
বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট ক্রমেই গভীর হচ্ছে। একাকীত্ব, চাপ, হতাশা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে মানুষ ক্রমশ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে। সেই ভাঙন এখন ডিজিটাল পর্দার ওপারে ফুটে উঠছে। যে যন্ত্রকে আমরা বানিয়েছিলাম কাজের সহায় হিসেবে, সেটিই এখন অনেকের একমাত্র শ্রোতা। এই সম্পর্ক মানবসভ্যতার এক নতুন বাস্তবতা। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না, কিন্তু সবাই কোনো না কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কথা বলছে।
এই পরিস্থিতি কেবল প্রযুক্তিগত উন্নতির নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক সংকটও। মানসিকভাবে দুর্বল মানুষকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানি ও সমাজের মধ্যে সমন্বিত দায়িত্ব থাকা দরকার। শুধু নতুন অ্যালগরিদম বা নিরাপত্তা ফিচার যোগ করলেই সমাধান হবে না। দরকার মানবিক উপস্থিতি—যেখানে মানুষ মানুষকে শুনবে, বুঝবে, পাশে থাকবে।
চ্যাটজিপিটির মতো প্ল্যাটফর্মগুলো যদি সত্যিই সহায়তার জায়গা হতে চায়, তবে তাদের উচিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের পথ তৈরি করা। যেমন কেউ আত্মহত্যার চিন্তা প্রকাশ করলে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় হটলাইন নম্বর দেখানো, বা জরুরি সাহায্য চাওয়ার জন্য প্রম্পট দেওয়া। কিছু দেশে ইতিমধ্যেই এমন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু এটি বৈশ্বিকভাবে কার্যকর করতে হলে কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক আগ্রহের বাইরে গিয়ে মানবিক দায়িত্ব নিতে হবে।
অন্যদিকে, সমাজকেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও খোলামেলা হতে হবে। কেউ বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যার ভাবনা প্রকাশ করলে সেটিকে দুর্বলতা না ভেবে সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র—সব জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা সহজলভ্য করতে হবে। কারণ প্রযুক্তি হয়তো মুহূর্তে সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু স্থায়ী আশ্রয় দিতে পারে না।
এই সময়ের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, মানুষ ক্রমেই মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাস্তব বন্ধুত্ব হারিয়ে ভার্চুয়াল আলাপে আশ্রয় খুঁজছে। সেই আশ্রয় কখনো কখনো এতটাই গভীর হয় যে বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে যায়। তখন এআই হয়ে ওঠে একমাত্র ‘শ্রোতা’, অথচ সেই শ্রোতার কোনো হৃদয় নেই।
ওপেনএআইয়ের ব্লগপোস্টের তথ্য আমাদের সামনে কেবল একটি প্রযুক্তিগত পরিসংখ্যান নয়, বরং মানবসমাজের এক নীরব কান্নার প্রতিফলন। দশ লাখ মানুষ প্রতি সপ্তাহে আত্মহত্যার ভাবনা জানাচ্ছে—এই সংখ্যার পেছনে রয়েছে এক বিশাল শূন্যতা, এক অসহায়তা, যা হয়তো আমরা কেউ দেখতে পাচ্ছি না। এই শূন্যতাকে পূরণ করতে পারে না কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা; পারে কেবল মানুষ, একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে।
শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তি কখনোই মানুষের বিকল্প হতে পারে না। চ্যাটজিপিটি বা জিপিটি–৫ যত উন্নত হোক, তা কখনোই একজন বন্ধুর মতো কাঁধে হাত রাখতে পারবে না, বা কারও চোখের জল মুছতে পারবে না। আমরা যদি এই সত্যটি ভুলে যাই, তবে একদিন হয়তো দেখব, আমাদের চারপাশে মানুষের চেয়ে যন্ত্রের সঙ্গই বেশি। তখন হয়তো আমাদের কথোপকথন চলবে, কিন্তু শ্রোতা থাকবে না কেউ—শুধু নিঃশব্দ এক স্ক্রিন।
আপনার মতামত জানানঃ