খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতকের অন্ধকারের মাঝে পারসিস নামক একটি পাহাড়ি জনপদ, যেখানে মানুষ ছিল মূলত কৃষিজীবী এবং স্বল্পসংখ্যক গোত্রভিত্তিক শাসনের মধ্যে ভাগ করা, তার পার্থক্য মনে রাখার মতই। পারসিসের বাসিন্দারা ছিল পরিচিত না, পরিচ্ছন্ন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তারা ছিল অপ্রকাশিত একটি অংশ; তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ছিল বাহারতের বড় শহরগুলোর তুলনায় কম পরিচিত, কম আলোচিত। কিন্তু ৫৫৯ খ্রিস্টপূর্ব্বে একটি পরিবর্তন শুরু হয় যখন সাইরাস—যিনি পরে “সাইরাস মহান” খ্যাত হবেন—দরবারে উন্নীত হন এবং পারসিসের মধ্যকার বিভাজন ও বাধাকে পার করে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে উঠেন।
সাইরাসের শাসনের সূত্রপাত হয় মিডস রাজ্যের রাজা অ্যাস্টিয়াজেস-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে। মিডস তখন পারসিসের উপরে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো; পারসিসদের ভাগ্য ছিল মিডসের শাসনাধীন বলে ধরা। কিন্তু সাইরাস কেবল যুদ্ধের মাধ্যমেই নয়, রণনীতি, রাজনীতির চাতুর্য, এবং কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমেও এগিয়ে গিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ সীমান্তে গণনা ও যুদ্ধপ্রস্তুতি ছাড়া, তিনি মধ্যবর্তী শাসনব্যবস্থার বিষয়গুলো পরিবর্তন করেননি, বরং স্থানীয় শাসকদের ক্ষমতা ও সংস্কৃতিকে সম্মান করেন। এই নীতি তার রাজত্বকে স্থিতিশীল করে তোলে, কারণ যে জনগণ নতুন শাসকের অধীনে এসেছে তারা কিছুটাই পুরাতন রীতিতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে পারে।
তারপর তিনি লিডিয়া রাজ্যের দিকে নজর দেন—এটা ছিল সূর্যের অগ্রভাগে অবস্থিত একটি শক্তিশালী রাজার শাসিত এলাকায়, ধন-সম্পদে লিপ্ত, সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত। লিডিয়া জয় তার সাম্রাজ্যকে আকার দিতে একটি বড় ধাপ ছিল। শহর সারডিস ধ্বংস করার পর সাইরাসকে এখন এশিয়া মাইনরের উপকূলবর্তী শহরগুলোর দরজা খুলে যায়, যা পরে বৃহত্তর বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ এনে দেয়। উপকূলবর্তী শহরের গির্জা ও মন্দিরগুলো, বিভিন্ন ভাষার বসবাসকারীরা, ব্যবসায়ীরা এখন পারসিয়ার শাসনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে।
কিন্তু সবচেয়ে স্মরণীয় এবং প্রভাবশালী ঘটনা হয় ব্যাবিলন দখলের সময়। খ্রিস্টপূর্ব্ব ৫৩৯ সালে সাইরাস ব্যাবিলন শহর প্রবেশ করেন, একটি শহর যা তখন বিশ্বের সবচেয়ে ধন-সম্পদে ভরপুর, শক্তিশালী প্রশাসন ও সুপরিকল্পিত কাঠামোর জন্য বিখ্যাত। ব্যাবিলন ছিল শুধু একটি কেলেব্রেটেড শহরই নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বিজ্ঞান-মনস্ক কেন্দ্র; তার বিশাল প্রাচীর, খুশির উৎসব, মন্দির—সব কিছুই রাজ্যের শক্তি ও ঐশ্বর্য নির্দেশ করতো। সাইরাস ব্যাবিলন প্রবেশের সময় যুদ্ধবিরোধী বাহিনী ও প্রতিবন্ধকতাটি বড় ছিল, তবে তার পরিকল্পনা ও সামরিক দক্ষতা সে বাধা পার হয়।
ব্যবিলনে জয় করেই সাইরাস একটি বিশেষ নথি ধারণ করেন—সাইরাস সিলিন্ডার—যেখানে কিউনিফর্ম লিখায় লেখা আছে, জয় উপলব্ধি করা হয়েছিল সহনশীলতার এবং প্রশাসনিক ন্যায়বিচার দিয়ে। এই সিলিন্ডার শুধুমাত্র একটি বিজয়ের ঘোষণা ছিল না; এটি একটি আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করছিল—অনুগত জনগণকে অধিকার দেওয়া, তাদের ধর্ম ও রীতি-নীতি বজায় রাখার সুযোগ। যেমন নির্যাতন ও ধর্ম-দমন এড়িয়ে চলা, বন্দীদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া, ধর্মীয় উপাসনার স্থানগুলোর মর্যাদা রক্ষা করা—এসব নীতি সাইরাসের শাসনে স্পষ্ট ছিল।
সাইরাসের রাজনীতি ছিল কেবল জয় ও দখলের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং জনতার চাহিদা ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। মিডস ও পারসিসের গোষ্ঠীগুলোকে একত্রে রাজ্য পরিচালনায় অংশ নিতে দেওয়া হয়েছিল, মধ্যম পর্যায়ের শাসকদের ক্ষমতা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। প্রশাসন খণ্ডিত না করে সংস্কৃতি ও ভাষার বৈচিত্র্য বজায় রাখা হয়েছিল। এই নীতি তার সাম্রাজ্যকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে বিভিন্ন জাতি ও ভাষার মানুষরা এক সাধারণ আনুগত্যবোধ ও রাজনৈतिक স্থিতিশীলতার অভিজ্ঞতা করতে পারে।
এই শক্তি ও সাম্রাজ্য বৃদ্ধিতে সাইরাসের নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গা ছিল মূল চাবিকাঠি: মিলিত শাসন, রাজনৈতিক কৌশল, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সহনশীলতা, এবং জনসাধারণের প্রতি মানবতাবোধ। সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল পশ্চিমে বলকান ও মিশর থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার পাহাড় ও মিডিয়া অঞ্চলের মাধ্যমে, এবং দক্ষিণ-পূর্বে সিন্ধু উপত্যকার দিকে; পথচারীদের জন্য, বণিকদের জন্য, এবং যারা শান্তি চান তাদের জন্য তিনি একটি ওপেন রাস্তা তৈরি করেছিলেন।
তার মৃত্যুর পর তিনি একটি স্থিতিশীল ভিত্তি রেখে গিয়েছিলেন, যা পরে একা একা রাজা নয়, রাজাদের শ্রেণীর মধ্যে একটি অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে কাজ করে; রাজা দারিউস, জাক্সারস প্রভৃতি তার প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা—শাসনব্যবস্থা, প্রদেশভিত্তিক গভর্নর (স্যাট্রাপ), ডাকপরিষেবা, রাজ্য সড়ক ও সেচ প্রকল্প—এসবই তার উত্তরসূরীদের গৃহীত নীতি। জীবনের শেষে সাইরাস শুধুমাত্র একটি আকাঙ্ক্ষিত শাসক নয়, বরং এক প্রতীক হয়ে ওঠেন—বিদ্বান, নেতা, মুক্তিদাতা এবং মানবাধিকারের চেতনাবোধ যুক্ত এক শাসক।
সময়ের মোড়ে, পারস্য সাম্রাজ্য অমূল্য ঐতিহ্য হয়ে ওঠে; শিল্প, মূর্তি, স্থাপত্য, সাহিত্য ও প্রশাসনে তার ছাপ আজও রয়ে গেছে। প্রাচীন অবকাঠামো যেমন পার্সি প্রাসাদ, পারসেগাদে ও পার্সিপলিস-এর ধ্বংসাবশেষ আজও ইতিহাসপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। সাইরাসের নাম আজও স্মরণে থাকে শুধুমাত্র বিজয়ীরূপে নয়, বরং এক মহান শাসকেরূপে, যার ন্যায়, ক্ষমতার সীমানা ও ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ববোধ ছিল অপরিমেয়। তিনি দেখিয়েছিলেন যে বৃহৎ শক্তি অর্জন করলে সেটি শুধুমাত্র অস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে নয়—মানবিকতার, ন্যায্যতার ও দৃষ্টিভঙ্গার ওপর ভিত্তি করেও সাম্রাজ্য পরিচালনা করা যায়।
আপনার মতামত জানানঃ