এক আইনজীবীকে ফাঁসাতে যশোরের কেশবপুর থানায় বোমা মারতে ওসিকে নির্দেশ দেন বলে সাংসদ শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। যশোরের কেশবপুরের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সাইফুল্লাহকে ফাঁসাতে ওসি জসিম উদ্দীনকে এ নির্দেশ দেন সাংসদ শাহীন চকলাদার। চাকলাদার যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেশবপুর (যশোর–৬) আসনের সংসদ সদস্য। শাহীন চাকলাদার এবং কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দীনের এ কথোপকথনের কল রেকর্ড ফাঁস হলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে অডিও রেকর্ডটি।
সপ্তাহ দুয়েক আগে কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দিনের মোবাইল ফোনে কল করে চাকলাদার এই নির্দেশনা দেন। সাংসদ যার বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেছেন সেই সাইফুল্লাহ ওই এলাকার একজন পরিবেশবাদী কর্মী। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সঙ্গে মিলে তিনি কাজ করেন। সম্প্রতি ওই এলাকায় ‘মেসার্স সুপার ব্রিকস’ নামে অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা একটি ইট ভাটার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন সাইফুল্লাহ। আদালত ইট ভাটা বন্ধের নির্দেশনাও দেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন সাংসদ শাহীন চাকলাদার। তিনি কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দীনকে ফোন করে থানায় বোমা মেরে ‘ডাকাতি’ চেষ্টার অভিযোগ এনে সাইফুল্লাহকে মামলার আসামি করতে বলেন।
শাহীন চাকলাদার নিজের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে ওসি জসিম উদ্দীনকে ফোনে বলেন, ‘আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠাণ্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। সে (সাইফুল্লাহ) বারবার যেয়ে রকন করে, আপনি কী করেন?’ এর উত্তরে ওসি বলেন, ‘ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।’ এরপর শাহিন চাকলদার বলেন, ‘আরে কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?’
এক পর্যায়ে শাহীন চাকলদার ওসির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ওসি হলি, ওসি কিন্তু ডায়নামিক হইতে অয়। আজকে বাঘারপাড়া ওসি আসছিল আমার কাছে। ওরে আবার চৌগাছায় দিয়ে দিচ্ছি। ওসি.. চেনেন? বাঘারপাড়া ওসিকে চেনেন? কথা বইলেন তার সাথে। তাকে নিয়ে আসতেছি চৌগাছায়। আপনে ওকে যেকোনো ভাবে, যেকোনো লোক দিয়ে, কাইলকে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে কালকে কাজটা করেন, ওকে?’
জবাবে ওসি বলেন, ‘স্যার, দেখি স্যার। কী হয়েছে স্যার? ও কি ডিস্টার্ব করতেছে আবার?’ উত্তরে শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘ও কী ডিস্টার্ব করবে? আচ্ছা, বন ও পরিবেশ অফিসে আমি আছি। কার বাপের ক্ষমতা আছে এখানে আসবে! আমি বলছি কী, একটা আপনি খেলা খেলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। কথা বুঝেন নাই?’
এক পর্যায়ে শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘বেলা-ফেলা আমি দেখবোনে, আমি তো স্থায়ী কমিটির সদস্য।’ তখন ওসি বলেন, ‘হাইকোর্টের কাগজটা স্যার।’ শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘হাইকোর্ট কী বলেছে?’ ওসি বলেন, ‘গতকাল একটা কাগজ আসছে হাইকোর্টের থেকে স্যার।’ শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘কী আছে?’ এর উত্তরে ওসি বলেন, ‘আমি দেখাবনে স্যার কালকে। কালকে সকালে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেবোনে আপনারে, স্যার। হাইকোর্ট থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসছে ওই যে, সুপার ব্রিকস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিসে স্যার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ শাহীন চাকলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা ওসির সঙ্গে তার হয়নি। এটা কেউ টেম্পারিং করে বানিয়েছে। সাংসদ শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘আমি যে এলাকার সাংসদ, সেটা জামায়াত–অধ্যুষিত। এখানে কেউ এটা বানিয়েছে। এ ধরণের কোনো কথা হয়নি। ওসিও আমাকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো কথা হয়নি।’
কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দীন বলেন, ‘এমপির সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে কথা হয়। তবে এই ধরনের কোনো ফোনালাপ হয়েছে- এটা স্মরণে আসছে না।’ তবে যশোরের একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই ফোনালাপের কণ্ঠ কেশবপুর থানার ওসির, এটা নিশ্চিত।
এদিকে এই ঘটনায় শনিবার কেশবপুর থানায় জিডি করেছেন সাইফুল্লাহ। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, শাহীন চাকলাদার ওসিকে যে মামলা করতে বলেছেন তাতে তিনি বর্তমানে জান-মালের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই তিনি আইনের সহায়তা চান।
পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সাইফুল্লাহ বলেন, ‘সাতবাড়িয়ে এলাকায় স্কুলের পাশে ইটভাটা তৈরি করেছিল। সেটি উচ্ছেদের জন্য হাইকোর্টে রিট করেছিলাম। এতে এমপি আমার ওপর ক্ষেপে যান। তিনি ওসিকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেটি নিয়ে সংবাদ দেখলাম। পরে আমি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। বর্তমানে এ নিয়ে ভয়ে আছি। কেশবপুরের ওসিও আমাকে বলেছেন, সাবধানে থাকতে। একা যাতে কোথাও না যাই।’
এ বিষয়ে বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, সাইফুল্লাহ তাদের নেটওয়ার্ক মেম্বার। তিনি বলেন, একজন ইটভাটার মালিকের পক্ষ হয়ে একজন সাংসদের এমন অবস্থান প্রমাণ করে, পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা কতটা নাজুক অবস্থার মধ্যে আছেন। পুলিশকে চাপ দেওয়ার জন্য সাংসদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এই সাংসদ আদালতকে মানতে চান না। তিনি কীভাবে আইনপ্রণেতার ভূমিকায় থাকতে পারেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘একটা ইটভাটা যেটার ডিসির লাইসেন্স নেই, ডিওইর ক্লিয়ারেন্স নেই। যারা ভুক্তভোগী তারা খেজুর বাগানের মালিক। যশোরের খেজুর বাগান বিখ্যাত। সেখান থেকে দেশের গুড়ের সাপ্লাই আসে। এরকম এলাকাতে লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চলবে, একজন আইনপ্রণেতা হয়ে সেটার বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে, ভুক্তভোগীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে যারা কথা বলছে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নেবেন। একজন জনপ্রতিনিধি ও আইনপ্রণেতার এই কাজ করাটা মানায় না। ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি যে প্রস্তাবনা করেছেন, সভ্য জগতে এরকম প্রস্তাবনা হতে পারে না।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫১
আপনার মতামত জানানঃ