পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য নূরুজ্জামান বিশ্বাসের ছেলে দোলন বিশ্বাসের নেতৃত্বে পাঁচ ট্রাক লোহা চুরির চেষ্টা করা হয়। আর এ চুরির খবর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়ায় এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে এমপিপুত্র। গতকাল মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে পাবনার রূপপুর পারমানবিক প্রকল্প সংলগ্ন নতুন হাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যবসায়ীর নাম সোহেল রানা (৪৫)। তিনি প্রকল্পের সাব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বাংলা পাওয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বাংলা পাওয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রানা অভিযোগ করে বলেন, “পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান বিশ্বাসের ছেলে দোলন বিশ্বাস ও তার সহযোগীদের সিন্ডিকেট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ রড অবৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঁচটি ট্রাকে করে প্রকল্প এলাকা থেকে বের করার চেষ্টা করছিল। বিষয়টি সোহেল ও তার সহকর্মী কামরুল হাসান রাসেলের নজরে এলে তারা প্রকল্পের প্রশাসনিক বিভাগকে জানান। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক রডভর্তি ওই পাঁচটি ট্রাক আটক করেন। এ সময় ট্রাকগুলোর চালকদের কাছে বৈধ গেট পাস ও চালানপত্র না থাকায় তাদের প্রকল্প এলাকা থেকে বের হতে না দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। প্রকল্প এলাকা থেকে রডের চালান বের করতে না পারার এ খবর এমপিপুত্র দোলন বিশ্বাস জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন। তিনি ১৫-২০ জন সশস্ত্র সহযোগী নিয়ে নতুনহাট এলাকায় বাংলা পাওয়ার সার্ভিসের অফিসে হামলা চালান”।
তিনি বলেন, “হামলাকারীরা অফিসে ঢুকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভাঙচুর চালায় এবং আমাকে লোহার রড দিয়ে পেটাতে শুরু করে। এ সময় নারীকর্মীরা ছুটে এসে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমার চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে এলে তারা চলে যায়।”
বাংলা পাওয়ার সার্ভিসের নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান রাসেল বলেন, রূপপুর প্রকল্পে আমরা দীর্ঘদিন স্বচ্ছতার সাথে ক্লিনিং সার্ভিস পরিচালনা করছি। প্রকল্প এলাকা থেকে জাল কাগজ তৈরী করে দীর্ঘদিন ধরে দোলন বিশ্বাসের অনুসারী একটি চক্র মালামাল পাচার করে বিক্রি করে। এই চক্রের হয়ে প্রকল্প এলাকায় কাজ করেন সাব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিকিমথ এর দোভাষী নাজমুল ও অমিত। তারা প্রতিনিয়ত ঈশ্বরদী শহরে দোলন বিশ্বাসের সাথে পরিকল্পনা করে প্রকল্পের মালামাল লুট করে আসছে।
রাসেল আরও জানান, যেহেতু আমরা প্রকল্পে ক্লিনিং সার্ভিস দেই এ কারণে কোনো কিছু খোয়া গেলেই কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। নিজেদের স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে আমরা এই চক্রের অপকর্ম প্রশাসনকে অবহিত করায় চক্রটি হাতে নাতে ধরা পড়ে। এ কারণেই দোলন বিশ্বাস ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের হত্যার চেষ্টা চালায়। আমাকে না পেয়ে আমার স্ত্রী শারমিনা ইয়াসমিনকে গলাকেটে হত্যার হুমকিও দিয়েছে তারা।
কামরুল হাসান রাসেল বলেন, ঘটনার পর গুরুতর আহতাবস্থায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রানাকে নিয়ে ভয়ে আমরা ঈশ্বরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে পারিনি। পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়ার চেষ্টা করলে সেখানেই দোলনের সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের পিছু নেয়। প্রাণ ভয়ে আমরা ঢাকার পথে রওনা হয়েছি। আমাদের প্রতিনিধি থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুসের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রূপপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এমপিপুত্র দোলন বিশ্বাসের অনুসারী জয়নগর এলাকার ফরিদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকা থেকে বিভিন্ন মালামাল মাঝেমধ্যে বের করা হয়, তবে তা বৈধ না অবৈধভাবে করা হয় তা আমার জানা নেই।’
ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফিরোজ কবীর বলেন, ‘বাংলা পাওয়ার সার্ভিসের অফিসে হামলা ও এক ব্যক্তিকে জখমের খবর পেয়েছি। লিখিত অভিযোগ পেলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে লোহা চুরি চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী আটঘরিয়া) আসনের সংসদ সদস্য নূরুজ্জামান বিশ্বাসের ছেলে দোলন। তিনি বলেন, “রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের মতো একটি সুরক্ষিত এলাকা থেকে মালপত্র চুরি অসম্ভব কল্পনা।”
হামলার অভিযোগও অস্বীকার করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতেই আমাকে জড়িয়ে অসত্য অভিযোগ করা হচ্ছে।”
সংশ্লিষ্ট বিশেশজ্ঞরা মনে করেন, পিতা স্থানীয় সাংসদ হবার সুবাধে পুত্রদের অবাধ চলাফেরার এক অলিখিত স্বাধীনতা থাকে। এর ফলে নিজেদের ইচ্ছেমতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা লুটার ধান্দায় লিপ্ত থাকে। রূপপুর প্রকল্পের এইসব লৌহসামগ্রী তুলে নিয়ে বিক্রি করার স্বাধীনতাটা এমপিপুত্র সেখান থেকেই অর্জন করেছে এবং এর বাঁধা দিতে আসা লোকদের পিটিয়ে হজম করা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, স্থানীয়ভাবে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার কতটা করে থাকে। এবিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ