নেপালে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে ঘিরে যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা শুধু একটি আইনি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং তরুণ প্রজন্মের জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। রাজধানী কাঠমান্ডুতে হাজার হাজার তরুণ যখন পার্লামেন্টের সামনে সমবেত হয়, তখন তাদের হাতে শুধু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিই ছিল না, বরং দুর্নীতি, বৈষম্য এবং সরকারের প্রতি অনাস্থার প্রতীকী স্লোগানও ছিল। “Enough is Enough” বা “End to Corruption” লেখা প্ল্যাকার্ড থেকে স্পষ্ট যে এই আন্দোলন বহুমাত্রিক।
সরকার বলছে, ফেক নিউজ, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং অনলাইন জালিয়াতি ঠেকাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তরুণদের চোখে এটি তাদের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যতের ওপর সরাসরি আঘাত। কারণ জেনারেশন জি-এর জন্য সোশ্যাল মিডিয়া কেবল বিনোদনের জায়গা নয়; এটি শিক্ষা, ক্যারিয়ার, ব্যবসা এবং রাজনৈতিক মত প্রকাশের অবলম্বন। তাই প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হওয়ায় তারা নিজেদেরকে বঞ্চিত ও অবরুদ্ধ মনে করছে।
ঘটনাটি যেভাবে সংঘর্ষে রূপ নেয়, তা প্রমাণ করে তরুণদের হতাশা কতটা গভীর। বিক্ষোভকারীরা যখন পার্লামেন্ট ভবনের রেস্ট্রিক্টেড এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করে, তখন পুলিশ জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। এতে প্রাণ হারান অন্তত ১৯ জন, যার মধ্যে একজন শিশুও রয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এই মৃত্যু আরও ক্ষোভ জাগিয়ে তোলে, যা প্রতিবাদকে রাজধানী ছাড়িয়ে প্রদেশগুলোতেও ছড়িয়ে দেয়। পোখরাতে প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানেও কারফিউ জারি করা হয়।
সরকারি অবস্থান দ্ব্যর্থক। একদিকে তারা বলছে, তারা সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করতে চায় না, বরং আইন মেনে চলতে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করছে। অন্যদিকে তারা কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে তরুণদের মধ্যে আস্থা সংকট আরও বাড়াচ্ছে। এর মধ্যেই অন্তত দুটি প্ল্যাটফর্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করার পর আবার চালু হয়েছে। এতে বোঝা যায়, সরকার ধাপে ধাপে আপসের দিকেও তাকাচ্ছে।
তরুণদের ক্ষোভের কেন্দ্রে রয়েছে দুর্নীতি। নেপালে শিক্ষা থেকে চাকরি পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ সংস্কৃতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তরুণরা মনে করছে, তাদের প্রতিভা ও পরিশ্রমকে মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ক্ষমতাবানদের সন্তানরা সুবিধা পাচ্ছে। এক তরুণ বিক্ষোভকারীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে—“নেতা-মন্ত্রীদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হলে আমাদের কেন হবে না?” এই বাক্যটি পুরো প্রজন্মের যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি।
বিক্ষোভের আরেকটি দিক হলো সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ। সোশ্যাল মিডিয়া নতুন প্রজন্মের আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। সেটিকে বন্ধ করে দেওয়া মানে তাদের কণ্ঠরোধ করা। তাই এই প্রতিবাদ কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলনও বটে।
এখন প্রশ্ন হলো, এরপর কী? তিনটি সম্ভাবনা সামনে আসছে। প্রথমত, যদি সরকার দমননীতি অব্যাহত রাখে, তবে আন্দোলন আরও জোরদার হবে এবং দেশজুড়ে অস্থিরতা বাড়বে। দ্বিতীয়ত, যদি সরকার আপসের পথে হাঁটে এবং আংশিকভাবে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে, তবে হয়তো উত্তেজনা কিছুটা কমতে পারে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক চাপও নেপালের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। মানবাধিকার সংস্থা ও প্রতিবেশী দেশগুলো ইতিমধ্যেই নজর রাখছে।
দীর্ঘমেয়াদে এই আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে প্রজন্মগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। তরুণ প্রজন্ম এখন নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার এবং পরিবর্তনের দাবি স্পষ্ট করছে। তারা শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং দুর্নীতি ও বৈষম্যের অবসান চাইছে। এ অবস্থায় সরকার যদি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নেয়—যেমন স্বচ্ছ শাসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা—তাহলে সংকট আরও গভীর হতে পারে।
এই বিক্ষোভের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, নেপালের তরুণ প্রজন্ম আর নীরব দর্শক নয়। তারা তাদের প্রজন্মেই পরিবর্তন দেখতে চায়। আগের প্রজন্ম অবিচার সহ্য করলেও তারা করবে না। সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা কেবল একটি অজুহাত; আসল লড়াই একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক সমাজের জন্য।
আপনার মতামত জানানঃ