সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সাম্প্রতিক তিয়ানজিন সম্মেলন দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। এ সম্মেলন কেবল আঞ্চলিক সহযোগিতার মঞ্চ নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন ধারা সৃষ্টির ইঙ্গিতও দিয়েছে। একদিকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে অস্থির করে তুলেছে, অন্যদিকে এসসিও এই অস্থিরতার মধ্যে বহুপক্ষীয়তার শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে চাচ্ছে। এখানে চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন পরাশক্তি নিজেদের অবস্থানকে নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত বহন করে।
সম্মেলনে বিশ্বের বিশটি দেশ ও দশটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃবৃন্দ অংশ নিয়েছেন। এতে উপস্থিত ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ আরও অনেকে। এই বিশাল উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, এসসিও এখন কেবল আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক ফোরাম হিসেবেও গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বৈশ্বিক অস্থিরতার সময়ে আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত একক বিশ্বব্যবস্থার প্রতি পরোক্ষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা করেছেন যে, এসসিও ইউরেশিয়ায় একটি নতুন নিরাপত্তা কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করছে, যা পুরোনো ইউরোকেন্দ্রিক মডেলের বিকল্প হবে। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির উপস্থিতি দেখিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তিগুলোও এই বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে চায়।
এ সম্মেলনে সবচেয়ে বড় বার্তা হলো, চীন তার প্রভাব বিস্তারের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কৌশল গ্রহণ করছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও চীনের সম্পর্ককে আরও গভীর করা, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা মীমাংসার প্রচেষ্টা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্থাপনের উদ্যোগ স্পষ্ট হয়েছে। এর মাধ্যমে চীন শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক নেতৃত্বেও শক্ত অবস্থান নিতে চাইছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের চাপে বিকল্প শক্তি কাঠামোর প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে।
সম্মেলনে বহুপক্ষীয়তার যে ধারা জোরদার হয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও তাদের একই মঞ্চে দেখা যাওয়া একটি ইতিবাচক দিক। যদিও সীমান্ত সমস্যা ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব এখনো সমাধান হয়নি, তবুও চীন এই সমস্যাগুলো মীমাংসায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করা যায়। নেপাল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলোর জন্যও এটি হতে পারে নতুন সম্ভাবনার দরজা, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এই সম্মেলনের প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটি আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব বাড়াবে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য চীনের নতুন কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। তৃতীয়ত, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করার সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে। চীন যদি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে এই অঞ্চল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে এগোতে পারবে।
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই সম্মেলনের শিক্ষা হলো—বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ভেতর নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে বহুপক্ষীয় সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে বাণিজ্য, জ্বালানি, অবকাঠামো ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে এসসিও-র প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশকে নতুন কৌশলগত সুযোগ দিতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, এসসিও সম্মেলন বৈশ্বিক রাজনীতির একটি নতুন মোড় নির্দেশ করছে। একক আধিপত্যের পরিবর্তে বহুপক্ষীয়তা, সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা এখন বিশ্বব্যবস্থার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি এই পরিবর্তনকে কাজে লাগাতে পারে, তবে এ অঞ্চল শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শান্তির ক্ষেত্রেও নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারবে। তবে এ পথে হাঁটতে হলে আস্থা, সহযোগিতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ আরও জোরদার করতে হবে। ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশিয়া কতটা শান্তিপূর্ণ বা সংঘাতপূর্ণ হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে এই সম্মেলনের বার্তাগুলো বাস্তবায়নের ওপর।
আপনার মতামত জানানঃ