ভারতের বর্তমান ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটটি গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্কের জটিলতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা ও প্রভাবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
ভারত বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। নোমুরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চলমান বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন পুনর্গঠনের প্রেক্ষিতে ভারত লাভবান হতে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক উত্তেজনার কারণে।
তবে, এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতির ফলে ভারতের রপ্তানি খাতে প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে ওষুধ ও অটোমোবাইল খাতে।
ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়াতে সক্রিয় হয়েছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ।
চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবকাঠামো ও বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করেছে, যা ভারতের কৌশলগত প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে।
ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তবে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি ও বিনিয়োগ এই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো দেশগুলো চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।
ভারতের জন্য এখন সময় এসেছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে সমন্বয় করে দক্ষিণ এশিয়ায় তার নেতৃত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে। এটি অর্জনের জন্য, ভারতকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, যেমন বিমসটেক ও আসিয়ান-এর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।
এছাড়া, ভারতের উচিত চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়া, বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে। এটি শুধুমাত্র ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের বর্তমান কূটনৈতিক কৌশল তাকে একটি সংকটময় অবস্থানে নিয়ে এসেছে, যেখানে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং অন্যদিকে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তববাদী কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করাই ভারতের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পথ।
এদিকে,চীন-ভারত সীমান্ত ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে অন্যতম স্পর্শকাতর ও দীর্ঘস্থায়ী একটি বিরোধ, যার শিকড় ইতিহাস, জাতীয় স্বার্থ এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতার গভীরে প্রোথিত। এই সীমান্ত বিরোধ শুধু দুটি দেশের মধ্যকার একটি ভৌগোলিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির গতিপথেও গভীর প্রভাব ফেলে।
চীন ও ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৩,৪৮৮ কিলোমিটার, যা তিনটি সেক্টরে বিভক্ত — পশ্চিম সেক্টরে লাদাখ, মধ্য সেক্টরে উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশ, এবং পূর্ব সেক্টরে অরুণাচল প্রদেশ। এই তিনটি অঞ্চলের সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বারবার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, এবং কখনো কখনো তা সহিংস সংঘর্ষেও রূপ নিয়েছে।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ ছিল এই সীমান্ত বিরোধের সবচেয়ে চরম বহিঃপ্রকাশ। ওই যুদ্ধে চীন পশ্চিম সেক্টরে আকসাই চিন দখলে নেয়, যা ভারত এখনও নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। অপরদিকে, চীন পূর্ব সেক্টরে ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে “দক্ষিণ তিব্বত” বলে দাবি করে আসছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে দেখা গেছে। ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যাতে উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। এটি ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রথম প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। এরপর উভয় দেশ সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে এবং পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আরও বাড়ে।
এই বিরোধে কূটনৈতিক আলোচনা ও সামরিক স্তরের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও স্থায়ী সমাধান এখনও পাওয়া যায়নি। সীমান্ত চুক্তি ও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC) নিয়ে মতবিরোধ এবং দুই দেশের জাতীয়তাবাদী অবস্থান আলোচনাকে বারবার ব্যর্থ করে দিচ্ছে।
চীন-ভারত সীমান্ত ইস্যুটি শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর, এবং উভয়ের সঙ্গে অনেক দেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে। ফলে, সীমান্তে উত্তেজনা বাড়লে তা গোটা এশিয়া এবং বিশ্বের ভূরাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে, শান্তিপূর্ণ সংলাপ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস গঠনের মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান খোঁজার জন্য চীন ও ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সীমান্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং আঞ্চলিক সংযোগের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা বাড়ানো গেলে দীর্ঘমেয়াদে এই বিরোধ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।
চীন-ভারত সীমান্ত শুধু একটি রেখা নয় — এটি দুই প্রাচীন সভ্যতা, আধুনিক রাষ্ট্র এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার প্রতীক। শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথ খুঁজে পেতে হলে এই রেখাকে রক্ত নয়, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ