সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ইতিহাসে মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস নামটি একেবারেই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। প্রায় এক দশক আগেও যাকে কেউ চিনত না, তিনি আজ সৌদি আরবের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, ভবিষ্যতের বাদশাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই উত্থান কোনো সাধারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হয়নি, বরং ক্ষমতার অন্দরমহলে নাটকীয় পরিবর্তন, পরিবারের সদস্যদের গৃহবন্দি ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের আটক—সবকিছু মিলিয়ে এক বিস্ময়কর অথচ বিতর্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছে।
বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর নতুন বাদশাহ হন সালমান বিন আবদুল আজিজ। শুরুতে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ পান মুকরিন বিন আবদুল আজিজ, তবে মাত্র তিন মাস পরই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর জায়গায় আসেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ, যিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে সন্ত্রাসবিরোধী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একবার আল-কায়েদা আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা চালালেও তিনি বেঁচে যান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহ সালমান নিজের ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে বসানোর পথ প্রস্তুত করতে থাকেন।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হন এমবিএস। খুব অল্প সময়েই তিনি প্রমাণ করেন যে রাজনীতিতে তিনি কেবল প্রতীক নন, বরং ক্ষমতার মূল চালিকাশক্তি। লেখক ডেভিড বি. ওটাওয়ে লিখেছেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বাবার চারপাশে প্রাচীর গড়ে তুলতে শুরু করেন। বাদশাহকে পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এমনকি শোনা যায়, নিজের মা ও দুই বোনকেও তিনি গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরপরই ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের দমন অভিযানে নেতৃত্ব দেন এমবিএস। প্রথমে সৌদি জনতা এই পদক্ষেপের প্রশংসা করলেও দ্রুতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনা শুরু হয়। ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়কে অনেকেই এমবিএসের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের ফলাফল বলে মনে করেন।
এরই মধ্যে ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে হঠাৎ করেই ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। রমজানের এক রাতে বাদশাহ সালমানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সাফা মহলে গিয়ে ফাঁদে পড়েন নায়েফ। তার রক্ষীদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়, এবং ক্রাউন প্রিন্স পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। শেষ পর্যন্ত ওষুধবিহীন অবস্থায় ক্লান্ত নায়েফ পরদিন পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এরপর থেকে তিনি কার্যত গৃহবন্দি।
এই ঘটনার পর সৌদি রাজনীতিতে এমবিএসের উত্থান আর ঠেকানো যায়নি। তিনি হয়ে ওঠেন ক্রাউন প্রিন্স। তবে তার উত্থান কেবল রাজনৈতিক কৌশলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিকও তার চরিত্রকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। শোনা যায়, এক বিচারকের কাছে জমি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে তিনি বিচারকের টেবিলে গুলি রেখে হুমকি দিয়েছিলেন। আবার বিলাসবহুল সামগ্রীর প্রতিও তার আগ্রহ ছিল প্রবল। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটি চিত্রকর্ম কিনতে তিনি ৪৫ কোটি ডলার খরচ করেন এবং ৪৪০ ফুট দীর্ঘ একটি বিলাসবহুল ইয়ট কিনতেও দ্বিধা করেননি।
তবে এমবিএস কেবল বিতর্কের নাম নন, তিনি সৌদি সমাজেও কিছু পরিবর্তন এনেছেন। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া, ড্রেস কোড শিথিল করা এবং যুবসমাজকে বিনোদনমূলক আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়া তার নীতির অংশ। যদিও অনেক গবেষকের মতে, এসব পদক্ষেপ সমাজ সংস্কারের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই নেওয়া হয়েছিল, তবু সৌদি নারীদের জন্য এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ক্ষমতায় আসার পর তিনি সৌদি রাজপরিবারের মধ্যে চালু থাকা ‘শুরা’ বা পরামর্শমূলক ঐতিহ্য ভেঙে দেন। রাজনীতিতে সমঝোতার পরিবর্তে একক শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সমালোচনা বা বিরোধিতা যে তিনি সহ্য করবেন না, তা বারবার প্রমাণ করেছেন একের পর এক গ্রেফতার, সাংবাদিকদের কারাবাস এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মধ্য দিয়ে।
২০১৭ সালে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে বহু প্রিন্স, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেন। তাদের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে পাঁচতারা হোটেলে বন্দি করে রাখা হয়। সরকারকে বিপুল অর্থ ফেরত দেওয়ার পরই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। একইভাবে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরিকে সৌদি সফরের সময় হঠাৎ করেই পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাও আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার ঝড় তোলে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট আসে ২০১৮ সালে জামাল খাসোগজি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে গিয়ে এই সাংবাদিক খুন হন। সিআইএ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদনে সরাসরি এমবিএসের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও তিনি প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, সৌদি সরকারের হয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আর তাই সৌদি নেতার দায়িত্ব হিসেবে দায়ভার তার ওপরই বর্তায়।
সব সমালোচনা ও বিতর্ক সত্ত্বেও আজ এমবিএস সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ হিসেবে অনিবার্য। ১৯৮৫ সালে জন্ম নেওয়া এই যুবরাজ পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেননি, সেনাবাহিনী বা বিমানবাহিনীর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, কৌশলগত নির্মমতা এবং অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যেখানে তিনি কেবল রাজপরিবার নয়, পুরো দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছেন।
নারীর স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বিলাসবহুল জীবনযাপন, একের পর এক রাজনৈতিক পদক্ষেপ থেকে আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারি—সবকিছু মিলিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান এক রহস্যময় এবং বহুমুখী চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। সৌদি আরবের ইতিহাসে তার অধ্যায় নিঃসন্দেহে দীর্ঘস্থায়ী হবে। প্রশ্ন কেবল একটাই—তার এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসন সৌদি সমাজকে কতটা এগিয়ে নেবে, আর কতটা বিভাজনের দিকে ঠেলে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ