আফগানিস্তানের দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টির সংকট এখন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। দেশজুড়ে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার ঘাটতি মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন আজ মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করছে। বিশেষ করে শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন। গত এক মাসে অন্তত ১৮৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টির কারণে—এই সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ের নির্মম চিত্র। যখন পৃথিবীর একাংশে মানুষ অপচয় করছে খাবার, তখন আফগানিস্তানের হাজারো শিশু প্রতিদিন ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাচ্ছে এবং তাদের অনেকেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘদিন ধরেই অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম, আর নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। আন্তর্জাতিক সংস্থার অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে তহবিল না পাওয়ার কারণে। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের সঠিক চিকিৎসা বা পুষ্টি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গ্রামীণ এলাকায় অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে অনেক পরিবার দিনের পর দিন ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না। বাবা-মা নিজেরাই যখন না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, তখন শিশুদের জন্য সুষম খাদ্য জোগানো স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। দুধ, ডিম, ফলমূল, শাকসবজি তো দূরের কথা—অনেক সময় একবেলা রুটি বা ভাতও তাদের জোটে না। ফলে শিশুদের দেহে প্রাথমিক পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে এবং দ্রুত তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
অপুষ্টির দুটি বড় ধরণ আফগান শিশুদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে—ওয়েস্টিং বা তীব্র অপুষ্টি এবং স্টান্টিং বা দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি। ওয়েস্টিংয়ের ফলে শিশুর ওজন দ্রুত কমে যায়, দেহ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সামান্য সংক্রমণও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। আর স্টান্টিংয়ের কারণে শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। গবেষণা বলছে, আফগানিস্তানে প্রায় অর্ধেক শিশু কোনো না কোনোভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে লাখ লাখ শিশু ঝুঁকিতে আছে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর। যারা বেঁচে আছে, তাদের বড় অংশ ভবিষ্যতে পূর্ণ বিকাশে পৌঁছাতে পারবে না। এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও দীর্ঘমেয়াদে বাধাগ্রস্ত করবে।
কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? প্রথমত, আফগানিস্তান দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে। দুই দশক ধরে চলা সংঘাত দেশের অর্থনীতি ভেঙে দিয়েছে। বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পর অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, কৃষি খাত ভেঙে পড়েছে খরা, বন্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ায় আমদানিনির্ভর আফগানিস্তান আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারগুলো বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছে না। এছাড়া নারীদের কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে সংকট এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।
শিশুদের মৃত্যু শুধু এক মাসে ১৮৫ এ সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি চলমান বিপর্যয়ের অংশ। প্রতিটি মৃত শিশুর পেছনে রয়েছে একেকটি ভাঙা পরিবার, শোকার্ত মা-বাবা, এবং একটি সমাজ যা ধীরে ধীরে অসহায় হয়ে পড়ছে। অনেক মা বুকের দুধ দিতে পারছেন না কারণ তাদের নিজেদের শরীরেই পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। এই চিত্র শুধু আফগানিস্তানের নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য সংকটাপন্ন অঞ্চলেও দেখা যায়। তবে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে ভয়াবহ কারণ দেশটির ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একসঙ্গে শিশুদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব ছিল আরও কার্যকর সহায়তা প্রদান করা। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বারবার সতর্ক করেছে যে, আফগানিস্তানে অবিলম্বে অর্থায়ন না হলে লাখ লাখ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ এখনো পুরোপুরি জোগাড় হয়নি। অনেক সাহায্য সংস্থা বাজেট সংকটে নিজেদের প্রকল্প বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে হাজার হাজার শিশু চিকিৎসা ও পুষ্টি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ১৮৫ শিশুর মৃত্যু শুধু একটি মাসের হিসাব, কিন্তু আগামী মাসগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে যদি দ্রুত সমাধান না আসে।
অপুষ্টির এই ভয়াবহতা কেবল শিশুদের জীবনকেই নয়, পুরো সমাজকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অপুষ্টিতে বেড়ে ওঠা শিশুরা বড় হয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে, কর্মক্ষমতা কম হবে, এবং তাদের অসুস্থতাও বেশি হবে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার আগামী প্রজন্মের উপর। যদি সেই প্রজন্মই দুর্বল হয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে আফগানিস্তানের উন্নয়ন দীর্ঘদিন আটকে থাকবে। এটি কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং জাতীয় উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং শান্তির জন্যও বড় হুমকি।
সমাধান অবশ্যই আছে, তবে তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা পৌঁছানো দরকার—বিশেষত শিশু ও মায়েদের কাছে। হাসপাতালগুলোতে বিশেষ পুষ্টি সেবা ও চিকিৎসা পুনরায় চালু করতে হবে। শিশুদের জন্য “থেরাপিউটিক ফিডিং সেন্টার” স্থাপন করা প্রয়োজন যেখানে অপুষ্ট শিশুদের বিশেষ খাবার ও ওষুধ দেওয়া যাবে। একই সঙ্গে পরিবারগুলোকে সহায়তা করতে হবে যাতে তারা নিজেরাই খাদ্য কিনতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য দরকার কৃষি খাত পুনর্গঠন, পানির সংকট মোকাবিলা, এবং নারীদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি। নারীরা যদি আয় করতে পারে, তাহলে পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা বাড়বে এবং শিশুরা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি এই মৃত্যুগুলোকে কেবল সংখ্যা হিসেবে দেখব, নাকি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোকে প্রতিরোধযোগ্য ট্র্যাজেডি হিসেবে দেখব? প্রতিটি শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেত যদি সময়মতো সঠিক খাদ্য ও চিকিৎসা পেত। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক শক্তি, এবং স্থানীয় প্রশাসনের একসঙ্গে এগিয়ে আসা ছাড়া এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়। যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে আগামী মাসগুলোতে আফগানিস্তান আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে—যেখানে হাজার হাজার শিশুর জীবন ঝুঁকিতে থাকবে। মানবিকতার স্বার্থে, আর একটি শিশুরও যেন মৃত্যু না হয় কেবল ক্ষুধার কারণে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
আপনার মতামত জানানঃ