ঢাকার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ সম্প্রতি হিজাব ইস্যুতে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। বসুন্ধরা প্রভাতী শাখার ষষ্ঠ শ্রেণির ২০–২২ জন শিক্ষার্থী হিজাব পরে ক্লাসে উপস্থিত হলে শেষ পিরিয়ডে ইংরেজি শিক্ষক ফজিলাতুন নাহার তাদের শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দেন। এ ঘটনায় অভিভাবকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং দাবি করেছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে।
অভিযোগ ও তদন্ত
অভিভাবকদের অভিযোগ অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের শুধু শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করা হয়নি, বরং হিজাব পরার কারণে তাদের অপমানজনক মন্তব্যও শোনানো হয়েছে। একজন অভিভাবক জানান, তার মেয়েকে বলা হয়েছে, “হিজাব পরে কেন এসেছ, এতে তোমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছ।” অন্যদিকে, কিছু অভিভাবক দাবি করেছেন, “আমাদের সন্তানদের মাদ্রাসার ছাত্রীর মতো কেন সাজতে হবে বলে তিরস্কার করা হয়েছে।”
ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তিনি জানান, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে, যাদের ২৭ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার ভাষায়, “আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না, তবে অভিযোগ আসায় তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বজায় রেখেই সমাধান করতে হবে।”
শিক্ষকের ব্যাখ্যা
অভিযুক্ত শিক্ষক ফজিলাতুন নাহার নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, “স্কুলের নির্দিষ্ট ড্রেস কোড আছে। এখানে কেউ পর্দা করতে চাইলে সাদা স্কার্ফ পরে আসতে হবে। কিন্তু অনেকেই ওড়না পরে এসেছে। এটি নিয়ম ভঙ্গের শামিল। আমি তাদের নিয়ম শেখানোর জন্যই ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছি।” তার মতে, নিয়ম মানা না হলে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, এবং শিক্ষকের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের নিয়ম শেখানো।
ড্রেস কোড বনাম ধর্মীয় স্বাধীনতা
ঘটনার ফলে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সামনে এসেছে। একদিকে অভিভাবকেরা বলছেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যেখানে হিজাব ব্যবহার একটি স্বাভাবিক চর্চা। তাই শিক্ষার্থীদের হিজাব পরায় বাধা দেওয়া বৈষম্যমূলক এবং শিশুদের মানসিকভাবে আঘাত দিতে পারে।
অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ মনে করছে, ড্রেস কোড সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান নিয়ম তৈরি করে, যা শৃঙ্খলা, ঐক্য ও সমতা রক্ষা করে। কোনো শিক্ষার্থী যদি নিয়ম ভেঙে আলাদা পোশাক পরে আসে, তবে তা অন্যদের জন্য বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্কুলে ড্রেস কোড চালুর মূল উদ্দেশ্য হলো সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য আড়াল করা এবং সবার মধ্যে সমতা বজায় রাখা। একই পোশাক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি তৈরি করে। তবে একই সঙ্গে ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতাকেও অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশ একটি ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যময় দেশ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। হিজাব, ওড়না বা ইসলামি পোশাক এখানে অনেকের কাছে ধর্মীয় পরিচয়ের অংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস কিংবা কর্মক্ষেত্রে হিজাব ও পোশাকবিধি নিয়ে বিতর্ক একাধিকবার সামনে এসেছে। ফলে ভিকারুননিসার ঘটনা কেবল একটি স্কুলের সীমাবদ্ধ বিষয় নয়; এটি বৃহত্তর সমাজে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নও উত্থাপন করেছে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক তদন্ত। কমিটির প্রতিবেদন নিশ্চিত করবে শিক্ষকের আচরণ নিয়ম প্রয়োগের মধ্যে ছিল নাকি অযথা কঠোরতা দেখানো হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠান চাইলে স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে পারে যেখানে ধর্মীয় পোশাকের অনুমতি থাকবে কিন্তু তা নির্দিষ্ট ড্রেস কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা বজায় থাকবে, আবার শৃঙ্খলাও অটুট থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ