বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রশ্নটি যেন আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, পাশাপাশি দেশে নতুন করে মামলা ও গ্রেপ্তার, পরিস্থিতিকে আবার উত্তপ্ত করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের ইসলামপন্থি দলগুলো একে ‘নতুন নাটক’ বলছে, আর অনেকে এটিকে রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবেও দেখছেন।
পাঁচ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। সেই থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নীতিনির্ধারকরা জঙ্গিবাদ নিয়ে পূর্বেকার বয়ান থেকে কিছুটা সরে আসছেন। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পর্যন্ত বলছেন—বাংলাদেশে এখন জঙ্গিবাদের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। অথচ একই সময়ে নতুন করে মামলা, গ্রেপ্তার এবং ইসলামী ব্যক্তিত্বদের নাম মামলায় জড়ানো—এই দ্বৈত বার্তাই জনমনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
এক সময় দেশে জঙ্গিবাদ ছিল, এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। হলি আর্টিজানের হামলা, বিদেশি নাগরিক ও ব্লগার হত্যাকাণ্ড, আদালতে একযোগে বোমা হামলার মতো ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাসনিম খলিল, নেত্র নিউজের সম্পাদক, বলছেন—”হলি আর্টিজান হামলার দায় স্বীকার রাক্কা থেকে আইএস প্রকাশ্যে করেছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ।” আবার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার দায় আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা সরাসরি নিয়েছে।
তবে এসব বাস্তবতা থাকলেও, খলিলের মতে জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর প্রতিস্থাপন ও পরবর্তী ধারা এখন কিছুটা পরিবর্তিত। “প্রেসারের অভাবে তারা আর অস্তিত্ব সংকটে নেই, আবার সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর প্রয়োজনও বোধ করছে না। বরং অনেকেই মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে ঢোকার চেষ্টা করছে”—এই প্রবণতাকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী। একসময় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান হিসেবে অভিযুক্ত, আবার এখন জামিনে মুক্ত। তিনি বলছেন, অতীতে ‘জঙ্গি তকমা’ দিয়ে অনেক নাটক সাজানো হয়েছে। তবে একইসঙ্গে স্বীকার করছেন, কারাগারে থেকে কিছু উগ্রপন্থি সংগঠনের অস্তিত্ব তিনি নিজেও উপলব্ধি করেছেন। তাঁর মতে, যারা সত্যিকার অর্থে সশস্ত্র হিজরতের নামে পাহাড়ে-জঙ্গলে অবস্থান নিচ্ছে, তারা সরকারের নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে ইসলামপন্থি দলগুলোর অবস্থান এখনো সংবেদনশীল। সাভার থানায় গত ৫ জুলাই জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নতুন একটি মামলা হয় এবং তাতে ইসলামী আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ একজন আলেমের নামও উঠে আসে। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ অভিযোগ করেন, এটি ‘বিদেশিদের খুশি করার পুরনো নাটকের পুনরাবৃত্তি’। তিনি বলেন, “আসল অপরাধীকে বাদ দিয়ে যারা প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি করছে, তাদেরই জঙ্গি তকমা দেওয়া হচ্ছে।”
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হকের ভাষ্যেও রয়েছে স্পষ্ট সতর্কতা। তিনি বলছেন, “জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কেউ যেন সন্ত্রাসবাদে না যায়, সেজন্য আমরাও সচেতন। কিন্তু রাষ্ট্র যেন পুরনো নাটকের ফাঁদে পা না দেয়।” তাঁর মতে, আগের সরকার জঙ্গিবাদ ইস্যুকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসলামি আন্দোলন দমন করতে, এবং একই ভুল বর্তমান সরকার করলে সেটি আত্মঘাতী হবে।
জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানও তীব্রভাবে সরকারবিরোধী। দলটির মিডিয়া সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ দাবি করেন, অতীতে জঙ্গি হামলার সময় জামায়াতের কর্মীরাই আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের ছয়জন কর্মী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে জীবন দিয়েছেন। অথচ বারবার আমাদের জড়ানো হয়েছে এসব ঘটনায়, শুধু ইসলামকে বিতর্কিত করতে।”
এই সমগ্র বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি প্রশ্ন—বাংলাদেশে বর্তমানে কি জঙ্গি তৎপরতা সত্যিই নেই? ইসলামপন্থিদের একাংশ বলছে, নেই। কিন্তু তাসনিম খলিল বলছেন, “সন্ত্রাসবাদ এখন আর আলাদা করে অস্তিত্ব ঘোষণা করে কাজ করে না। নারীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বৈষম্য, ঘৃণা ও সহিংস ভাষার চর্চা এখন রাজনীতির মূলধারায় ঢুকে গেছে। ফলে আগের মতো সশস্ত্র সংঘর্ষের প্রয়োজন পড়ে না। তারা আগের চেয়ে অনেক কৌশলী ও অদৃশ্য।”
এই বাস্তবতায় আবারও দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন। প্রথমত, রাষ্ট্র কি জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে? দ্বিতীয়ত, প্রকৃত সন্ত্রাসীদের কী চিহ্নিত করা হচ্ছে, নাকি ‘চিহ্নিত’ নামেই শুধু নির্দোষদের টার্গেট করা হচ্ছে? তৃতীয়ত, আদৌ কি বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির পরিসরে কোথাও জিহাদি আদর্শ লুকিয়ে আছে, যা নতুন ছদ্মবেশে ফিরে আসছে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনই পাওয়া কঠিন। তবে স্পষ্ট হচ্ছে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ এখন আর কেবল অস্ত্রের ঝনঝনানিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি একটি রাজনৈতিক, আদর্শিক এবং রাষ্ট্রিক বিতর্কে রূপ নিয়েছে, যেখানে প্রত্যেকের নিজস্ব সত্য রয়েছে, আর এই সত্যের সংঘর্ষেই হয়ত আগামীদিনের বাংলাদেশের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় সহনশীলতার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ