
যখন বিশ্বজুড়ে আলোচনায় উঠে আসছে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা, ঠিক সেই সময়ই ফিলিস্তিনিদের রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাস্তবতা। আলোচনার ছায়াতলে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী আরও ৮২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা নিরীহ সাধারণ মানুষ। এই ঘটনাটি শুধু নির্মমতাকেই সামনে আনে না, বরং প্রশ্ন তোলে—আলোচনার নামে কি বিশ্ববাসী এক ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে চোখ বুজে রয়েছে?
প্রতিদিন গাজায় বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, ত্রাণ কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকার একটি হাসপাতাল বর্তমানে সেই বিপর্যয়ের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এক অনন্য সাহসিকতার নিদর্শন রাখছেন। তারা জানাচ্ছেন, সীমাহীন কষ্ট, বিদ্যুৎ ও ওষুধের ঘাটতি, বোমার শব্দ আর হতাহতের ঢলে হার না মেনে তারা হাসপাতাল চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে অন্তত আহতরা একটু স্বস্তি পান।
এক চিঠিতে এই চিকিৎসা কর্মীরা লিখেছেন, “আমাদের সম্পর্কে বিশ্বকে বলুন। বলুন, আমরা হয়তো মৃত্যুবরণ করবো, কিন্তু আমাদের মহৎ লক্ষ্য কখনোই ছাড়বো না।” তারা আরও বলেন, “আমরা সত্যিকারের মানুষ হওয়ার মানে বুঝে গেছি। এই যুদ্ধ আমাদের শেখাচ্ছে সহানুভূতি, আত্মত্যাগ ও দায়িত্ববোধের প্রকৃত রূপ।” এই কথাগুলো শুধুই একটি হাসপাতালের বার্তা নয়—এটি গাজার মানুষের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি।
অন্যদিকে, খান ইউনিসেই বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন একজন ইসরাইলি সেনা। তিনি ছিলেন গোলানি ব্রিগেডের একটি টিমের কমান্ডার। এই ঘটনা ইসরাইলি বাহিনীর জন্য বড় ধাক্কা হলেও, তার প্রতিক্রিয়া যেন আরও বেশি রক্তক্ষয়ের বার্তা নিয়ে আসে ফিলিস্তিনিদের জন্য। কারণ, প্রতিটি ইসরাইলি সেনার মৃত্যুর পরই দেখা যায় প্রতিশোধের নামে নির্বিচারে হামলা চালানো হয় গাজার বেসামরিক এলাকাগুলোর ওপর।
গাজায় পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে বেঁচে থাকার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে মানবিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা। মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে, কিন্তু মাথার ওপর ছাদ নেই। শিশুদের কান্না, বয়স্কদের হাহাকার আর আশাহত তরুণদের চোখে কেবল ধ্বংস, মৃত্যু আর অজানা ভবিষ্যতের ভয়।
তথাকথিত যুদ্ধবিরতির আলোচনায় আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নানা কূটনৈতিক ভাষায় সমাধানের কথা বললেও মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে এই হত্যাযজ্ঞ। অথচ বিচার নেই, নেই কার্যকর নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক সহিংসতা থামানোর দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টা।
বিশ্বের মানবতাবাদী সংগঠনগুলো যদি এখনই সোচ্চার না হয়, তাহলে এই নীরবতা ভবিষ্যতের আরও ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে। গাজার চিকিৎসকদের লেখা চিঠি আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাদের ভাষায়—“আমরা মরবো, কিন্তু মানবতা মরতে দেবো না।” এই ডাক শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার আর্তি।
এই পরিস্থিতি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—যুদ্ধ কেবল রাজনীতির ফল নয়, এটি হাজারো নিরীহ প্রাণের বিলুপ্তির উৎস। আর এই রক্তক্ষয়ের দায় শুধু দখলদারদের নয়, নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা সমগ্র সভ্যতার।
আপনার মতামত জানানঃ