বাংলাদেশের রাজনীতিকে যখন দেখার চেষ্টা করি, তখন বারবার ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ক্ষীণ অথচ তীব্র অন্তর্দৃষ্টিময় কবিতাটিতে—“মরীচিকা”। এই একুশ লাইনের কবিতায় কবি এক চরম আত্মবিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, যেখানে মানুষ নিজের চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যকার দোলাচলে কেবলই বিভ্রান্ত হয়। শেষ স্তবকে কবি বলেন, “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/ যাহা পাই তাহা চাই না।” এই চরণে যেন আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি আয়না প্রতিফলিত হয়। আমরা কি সত্যিই মরীচিকার পেছনে ছুটছি?
ছেলেবেলায় পাঠ্যবইয়ে মরীচিকা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। জানতাম, মরুভূমির ক্লান্ত পথিক দূরে জলের প্রতিচ্ছবি দেখে তা ধরতে ছুটে যায়। কিন্তু আসলে সেটা জল নয়, সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত বালির ধোঁকা। সেই বিভ্রমেই একসময় পথিক লুটিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মানুষও কি এমনই বিভ্রমে ছুটে চলেছে? রাজনৈতিক নেতারা যুগে যুগে আমাদের বলেছেন, তাঁদের দেখানো পথে চললে সুখ আসবে, প্রগতি আসবে, উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তব হবে। কিন্তু আমরা এখনো যেন সেই মরুভূমির পথিক—চলার শেষ নেই, গন্তব্যের খোঁজ নেই, কেবলই মরীচিকার ধোঁকায় দিশেহারা।
প্রতিটি নির্বাচনের আগে নেতারা ইশতেহার দেন—চমৎকার শব্দ, মনোহর প্রতিশ্রুতি। “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব”, “সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব”, “বৈষম্যহীন সমাজ গড়ব”—এসব বাক্যে যেন আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। কিন্তু শেষমেশ সেই স্বপ্নও যেন এক একটি মরীচিকার প্রতিফলন হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন—“অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু”—এসব আমাদের চাওয়ার কথা, আমাদের প্রাপ্তির কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা কেবলই পাই আশ্বাস, পাই চাতুর্য, আর পাই প্রতারণা।
বাংলাদেশের ইতিহাস একেকটি বৃত্তের মতো। একবার আশার জোয়ার আসে, তারপর হতাশার ভাটায় ভেসে যায় সবকিছু। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা, ১৯৭৫-এ পঁচন, ১৯৯০-এ স্বৈরাচারের পতন, ১৯৯৬-এ গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন, আবার ২০০৭-এ রাজনৈতিক রুদ্ধশ্বাস নাটক, সর্বশেষ ২০২৪-এ ‘ঐতিহাসিক’ পরিবর্তনের ডাক। কিন্তু পরিবর্তনের পরও প্রশ্ন থেকে যায়—তারপর? এই ‘তারপর’ এর জবাব যেন আজও মেলে না। মানুষ ভাবে, এবার হয়তো ভিন্ন কিছু হবে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা যায়, খেলোয়াড় বদলায়, মাঠ বদলায় না।
জনগণের ভালোবাসা, প্রত্যাশা আর স্বপ্নের ওপর দাঁড়িয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা এই আবেগকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। এই সিন্ডিকেট, এই স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী একের পর এক সুবিধা নেয়, অথচ জনগণ সেই জায়গায় থাকে যেখানে তারা ছিল। যারা একসময় হকার ছিলেন, তারা এখন স্যুট-বুট পরা ধনকুবের। যারা বলতেন “জনগণের সরকার”, তারা এখন বুলেটপ্রুফ গ্লাসের ভেতর বসে জনগণকে ভয় পান।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের সামনে একটি নতুন মোড় এনে দেয়। কেউ বলছে এটা ছিল বিপ্লব, কেউ বলছে বিদ্রোহ, কেউ আবার একে অভ্যুত্থান বলছে। কিন্তু আসলে এটা ছিল দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা ঘৃণা, ক্ষোভ আর হতাশার বিস্ফোরণ। মানুষ আর পারছিল না। এই দমবন্ধ সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়ন, একনায়কতন্ত্রের কুপ্রভাব—সবকিছু মিলে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, ছাত্র-শ্রমিক—সবাই। এটা কোনো দলীয় আন্দোলন ছিল না, ছিল না কোনো সুনির্দিষ্ট নেতা। এটি ছিল এক প্রজন্মের আর্তচিৎকার।
কিন্তু এই বিস্ফোরণের পর যা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। ক্ষমতা পরিবর্তন হলো, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। কিছু সুবিধাভোগী নতুন ক্ষমতায় এলেন, পুরনোদের জায়গা দখল করলেন। আবারও শুরু হলো সেই পুরনো খেলা—সংবিধান নিয়ে তর্ক, শব্দাবলি নিয়ে মল্লযুদ্ধ। কেউ বলছেন ‘খিলাফত চাই’, কেউ বলছেন ‘সমাজতন্ত্র চাই’। কিন্তু কেউ বলছে না, জনগণ কী চায়।
এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো চারটি খাতে দৃশ্যমান সংস্কার: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন এবং জননিরাপত্তা। এই চারটি খাতে যে ব্যর্থতা রয়েছে, তা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব জায়গায় কাজ শুরু করতে কি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? আজকের শিশুরা যদি আজই ভালো শিক্ষা না পায়, তাহলে আগামী প্রজন্ম কেমন হবে? আজ যদি একজন গরিব রোগী চিকিৎসা না পায়, তাহলে তার স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। আজ যদি মানুষ ভরসা করতে না পারে রাস্তায়, বাসে, থানায়—তবে স্বাধীনতা কেবল কাগজের অলঙ্কার হয়ে থাকে।
তাই বড় প্রশ্ন হলো—আমরা এখন কোন পথে যাব? আমাদের কি সেই পুরনো গলিপথেই ঘুরপাক খেতে হবে? নাকি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে?
একটি সামাজিক চুক্তির কথা এখনই ভাবতে হবে। আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে—এই দেশ একক কারও না, দল বা ব্যক্তির না, এই দেশ সবার। একে চলতে হলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা, বিরোধী দলের প্রতি শ্রদ্ধা, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা—এসব ছাড়া গণতন্ত্র বা উন্নয়ন কিছুই সম্ভব নয়।
‘৩৬ জুলাই’ কোনো সমাপ্তি নয়। এটি কেবল শুরু। যদি এটিকে আমরা অন্তর্দৃষ্টি, আত্মসমালোচনার সূচনা হিসেবে দেখি, তাহলে ভবিষ্যৎ গড়ার পথ তৈরি হতে পারে। নয়তো আবারও আমরা ছুটব সেই মরীচিকার পেছনে—একটি অদৃশ্য জলের খোঁজে, যা কোনো দিন ধরা দেবে না।
আপনার মতামত জানানঃ