পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ ২০১৩ সালে নিম্নতম মজুরি বোর্ডে বছরে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করে সরকার। দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর পর পর ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা করা হয়। ফলে ২০১৮ সালের মজুরি কাঠামোতেও বছরে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া বহাল রাখা হয়। কিন্তু গতকাল করোনা পরিস্থিতির অজুহাতে ক্ষতির শিকার দাবি করা পোশাক শিল্প মালিকরা আগামী দুই বছরের জন্য শ্রমিকদের মজুরি বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করতে চান না মর্মে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বরাবর এক চিঠি পাঠিয়েছেন।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের বড় দুই সংগঠনের একটি বিকেএমইএ গতকাল রোববার(২৭ ডিসেম্বর) শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানকে এই চিঠি পাঠান। সংগঠনের সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমানের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মজুরি বোর্ড ঘোষিত গেজেটে শ্রমিকদের বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির একটি বিধান রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় যেখানে শ্রমিক-কর্মচারীদের বর্তমান বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করাটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই বিভিন্ন খাতে যেখানে বেতন-ভাতা কমিয়ে দিয়েছে, সেখানে পোশাক খাতে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয় বলেই আমরা মনে করছি। আইনে থাকার কারণে কভিডের মধ্যে বিগত সময়েও আমরা ইনক্রিমেন্ট দিয়েছি। এ অবস্থায় ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির এ বিধানটি আগামী দুই বছরের জন্য স্থগিত করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
অন্যদিকে পোশাকশিল্পের মালিকদের আরেক সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি না দিলেও ইনক্রিমেন্ট একবছর স্থগিত রাখতে শ্রমসচিবকে মৌখিকভাবে অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে নতুন করে প্রণোদনা পেতে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংগঠনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা।
বর্তমান মজুরি কাঠামো অনুযায়ী সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকের মোট মজুরি পান ৮ হাজার টাকা। তার মধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেলে মূল মজুরি ২০৫ টাকা বৃদ্ধি পাবে। আর বাড়িভাড়া বাড়বে ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। সাকল্যে শ্রমিকের মজুরি বাড়বে ৩০৭ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যান্য গ্রেডেও একেক হারে মজুরি বাড়বে। এই সামান্য অর্থ না দেওয়ার অভিপ্রায় জানিয়েই শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে বিকেএমইএ।
কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার এ পর্যন্ত ১ লাখ ১১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকার মোট ২০টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রথম প্যাকেজটিই ছিল রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি ও বেতন দেওয়ার জন্য। পরে তহবিলটির আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানা মালিক নামমাত্র সেবা মাশুল বা সুদে ঋণ নিয়ে চার মাসের মজুরি দেন। দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানিতে গতি ফিরলেও বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেন উদ্যোক্তারা। তার আগে এপ্রিলে কারখানা বন্ধের সময়ে ৩৫ শতাংশ মজুরি কম দেন। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসও কম দিয়েছেন অধিকাংশ মালিক।
শ্রমিক নেতারা মনে করেন, পোশাকশিল্পের মালিকেরা এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও দুই বছরের জন্য ইনক্রিমেন্ট বন্ধের যে দাবি করেছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে শ্রমিকেরা উৎপাদন করছেন, তাদের তো সুপার ইনক্রিমেন্ট দেওয়া দরকার। আসলে মালিকদের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তারা যে শুধু মুনাফা বোঝেন, ইনক্রিমেন্ট বন্ধের দাবি তারই প্রমাণ। ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি না হলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বলে করেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সারা বছর যে মূল্যস্ফীতি হয়, সেটি সমন্বয় করার জন্যই ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সুতরাং মজুরি ৫ শতাংশ বাড়লেও মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি সমন্বয় হবে না। বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে মালিকদের দর-কষাকষি না করে শ্রমিকদের ঘাড়ে পুরোটা চাপিয়ে দেওয়ার এই মানসিকতা কাঙ্ক্ষিত নয় বলে মন্তব্য করেন তারা।
এসডাব্লিউ/পিএ/কেএইচ/১৬৫২
আপনার মতামত জানানঃ