১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তার জন্মের সময় সোভিয়েত-ভারত ব্লকের সহযোগিতা পেয়েছিল। সে সময় সংঘটিত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ওই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের সক্রিয় সমর্থক। সে সময়কার প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাই ঐতিহাসিকভাবে ভারতের শাসকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করে এবং তারা তা রক্ষাও করে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ভারত তার পরিবারের জীবিত সদস্যদের সহযোগিতা ও আশ্রয় দেয়।
মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটে এবং বাংলাদেশের মুখ আবার যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঘুরে যায়। সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে সত্তর দশকের শেষ দিকে বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলটি আওয়ামী লীগের দলত্যাগী নেতাকর্মী, দলছুট ভারতবিরোধী বামপন্থী ও আধুনিক মৌলবাদীদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জিয়ার সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায়ন করে এবং মুজিব হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেয়।
ইতিহাসের এই উত্তরাধিকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সব সময় মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রেখেছে, যদিও তাদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব সামান্যই। বিপদের সময় নিয়ম করেই এক দলের কর্মীরা অন্য দলে যোগ দেয় এবং তাদের সাদরে গ্রহণও করা হয়। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাইয়িদ, বিএনপি নেতা মওদূদ আহমেদ, তরুণ নেতা গোলাম মওলা রনি, এমনকি প্রবীণ নেতা ও বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কামাল হোসেনও এক্ষেত্রে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এমন ধারার উত্তরাধিকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময় বিদেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছে। বরাবরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের। অতীতে রাশিয়ার কিছু সংশ্রব থাকলেও এখন এক পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ছাড়া- সেখানেও ভারত অন্যতম সহযোগী- বাংলাদেশে তাদের তেমন কোনো অংশীদারি নেই। তবে বিগত বছরগুলোতে চীন ক্রমশ তার অবস্থান শক্ত করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত যেন হয়ে উঠেছে ‘নির্ধারক’ শক্তি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের এখনকার অবস্থান মূল চালিকাশক্তির, বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা করছে প্রতিবেশী এই বৃহৎ রাষ্ট্রটিই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের এখনকার অবস্থান মূল চালিকাশক্তির, বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা করছে প্রতিবেশী এই বৃহৎ রাষ্ট্রটিই।
১৮ আগস্ট বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর ভারত বশ্যতার স্বীকারোক্তি প্রকাশ্যে আসার পর দেশটিতে এ নিয়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ওইদিন মন্ত্রী আবুল মোমেন হিন্দু সম্প্রদায়ের এক প্রকাশ্য সমাবেশে ভাষণে বলেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, ভারত যেন তা করে সেজন্য তিনি ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী হিন্দু আধিপত্যবাদী ভারত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন, এটা সেখানকার জনগণের জন্য অপমানজনক। তবে প্রায় এক দশক হতে চল, সেটাই ঘটছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের স্বার্থের চেয়েও ভারতের স্বার্থকেই যেন বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করছে।
বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় নিয়ম করেই। বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে এর কোনো বিরোধিতা নেই। দুই দেশের মধ্যে নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন এক গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা এক্ষেত্রে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও সরকার নিশ্চুপ। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট-করিডরের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার প্রায় বিনামূল্যেই ভারতকে সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার নিজ জনগণকে যথাযথ সহায়তা না দিলেও, ঠিকই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর করোনা মোকাবিলা তহবিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বড় অংকের অনুদান দিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্যমূলক প্রভাবই গোচরীভূত হয়।
প্রশ্ন হলো, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিতীয় সারিতে জায়গা নিল, আর ভারত হয়ে উঠল প্রথম। চীনই বা এখানে কী করছে? আর ভারত ঠিক কবে প্রতিবেশী এই দেশটির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠল? বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে এখন অবধি ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অনেকেই তাই মনে করে, বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যের সূচনা ২০০৯ সাল থেকে। কিন্তু এটি সত্য নয়। কার্যত ২০০৯ সালেও বাংলাদেশে মূল নির্ধারক শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। কিন্তু ২০১৩ সালে এ চিত্র পাল্টে যায়, ওবামা সরকারের নীতির ফল হিসেবে বাংলাদেশে ভারতই হয়ে ওঠে মূল রাজনৈতিক ক্রীড়নক।
ওবামা পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বদলের আলাপে যাওয়ার পূর্বে আমলে রাখা জরুরি যে, ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে পাকিস্তানের প্রভাব রয়েছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র তারা এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের উত্থানের ঘোর বিরোধী। ফলে বিএনপির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নির্ধারিত মনে করা হতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভারত ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়ে উঠলে অবস্থা নতুন দিকে মোড় নেয়।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করতে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর অধীনে। তার দল বিজেপি ভারতের বিদেশনীতিকে যুক্তরাষ্ট্রমুখী করতে বড় ভূমিকা পালন করে। একই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ঘোষিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নীতি দুই দেশকে ‘ইসলামোফোবিয়া’র দৃষ্টিকোণ থেকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। তবে ইসলাম ধর্মীয় মৌলবাদ মোকাবিলা নয়, বাংলাদেশে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারিত হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চীনবিরোধী নীতি কৌশলের প্রেক্ষিতেই।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ওবামা প্রশাসন চীনকে মোকাবিলার লক্ষ্যে বিদেশমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন প্রণীত এশিয়া পিভট নীতির অধীনে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রণনৈতিক কৌশল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে তখন জাতিসংঘের সাধারণসভার অধিবেশনে যোগ দিতে চারদিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্র যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। দুই দেশের প্রধানের সেই সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নতুন গতি পায়।
একই সময়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার সংবিধান সংশোধন করে তার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দেয়। ভারত এ সময় মৌলবাদীদের সঙ্গে বিএনপির জোট বাধার বিষয়টিকে সামনে এনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে প্রকাশ্যে অবস্থান ব্যক্ত করে। এ সময় ওবামা-মনমোহন বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাকে বিএনপি সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথা জানান।
সেই সাক্ষাতে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কথা হয় এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ভারতের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে এগোতে তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। বিষয়টি সামান্য পরিসরে হলেও পত্র-পত্রিকায়ও এসেছিল। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত পত্রিকায় আলোচিত হয় না। তবু এটা তখন সংবাদ মাধ্যমে আসে, কারণ ভারত সরকার বিষয়টা জানান দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির এই বাঁকবদলের ফলাফল কিছুকালের মধ্যেই দৃষ্টিগোচর হয়। বাংলাদেশে নির্বাচনে ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেই নির্বাচনে যোগ দেয়নি। ৩০০ আসনের নির্বাচনে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগ ভোটের আগেই জয়লাভ করে কোনো প্রার্থী না থাকায়। যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একপ্রকার নীরব ভূমিকা গ্রহণ করে। এবং অল্পকালের মধ্যেই দেখা যায়, এর বিনিময়ে তারা ভারতের কাছ থেকে বড় নজরানা আদায় করে নিয়েছে।
ওবামার মেয়াদের শেষের দিকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সামরিক ঘাঁটি বিনিময় চুক্তি। ভারতের ইতিহাসে এমন চুক্তি এর আগে সম্পন্ন হয়েছিল রাশিয়ার সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। ২০১৬ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে ‘লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট (এলইএমওএ)’ নামের ওই চুক্তি সাক্ষরকে কেন্দ্র করে সামরিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য ছিল, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনও চুক্তি আগে কখনও হয়নি। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বিবিসিকে অ্যাশটন কার্টার বলেছেন,
“গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় পালাবদল। এর ফলে আমাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এখন একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে, এবং আমেরিকার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে আমরা শুধু আমাদের দীর্ঘকালের ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।”
ঐতিহাসিক এই চুক্তি সাক্ষরের মধ্য দিয়েই ভারত-মার্কিন সহযোগিতা নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়। ধারণা করা হয়, এই চুক্তির জন্য দর কষাকষি করতে, চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে এমন একটি চুক্তিতে ভারতকে আনতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রক্রিয়াটি ২০১৩ সালেই শুরু করে। চুক্তির পর থেকে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনবিরোধী ভূমিকায় ভারত আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার এবং পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্র কোথাও বাধাগ্রস্ত করছে না।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ট্রাম্প তার পূর্বসূরিদের নীতি এগিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানান, ভারত তাতে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। বাংলাদেশে বিএনপি নেতারা ট্রাম্পের বিজয়ে খুশি হন, তারা আশা করেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিদেশনীতি বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যকে খর্ব করতে পারবে। শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়া প্রশ্নে কিছুকাল সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই কাটায়। এরপর তারা নতুন নীতি ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি) কৌশল’ গ্রহণ করে। এটাও প্রণীত হয় চীনকে মোকাবিলা ও এ অঞ্চলে ভারতকে কেন্দ্রে রাখার পূর্বতন নীতির আলোকেই। ফলে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণও ভারতের কাছেই থেকে যায়।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র তার হিস্যা ভারতের হাতে তুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে ইউরোপিয়দের প্রভাব শূন্যে নেমে আসে। কার্যত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে, বিশেষত বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থ তুলনামূলক কম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবেই তারা এ অঞ্চলে কাজ করে থাকে। ইউরোপীয়দের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রই এতদঞ্চলে বাণিজ্যিক, সামরিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মার্কিনিদের নীতি বদল তথা ভারতকে অগ্রাধিকার দেয়ার নীতি গ্রহণের পর এই শক্তিগুলো কেউ এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো নীতি প্রণয়নের দিকে যায়নি। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ‘নির্ধারক’ ভূমিকা দখল করেছে। ট্রাম্প আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ হওয়াটাও ভারতকে বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছে। নইলে পাকিস্তানের প্রভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভাবনার দিকে যাওয়ার সুযোগ হয়তো কিছুটা ছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের নির্ধারক ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য পশ্চিমাদের বাইরে একমাত্র অবশিষ্ট পক্ষ হলো গণচীন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি ও ভারতের পদক্ষেপগুলো মোকাবিলায় তারা বেশ কৌশলী পথ অনুসরণ করে। অনেক দিন থেকেই তারা ভারতের চারপাশে পাল্টা উপদ্রব তৈরি করছে, পাকিস্তান তো ছিলই, মিয়ানমারেও রয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী, এরপর যুক্ত হয়েছে নেপাল। মাঝে মালদ্বীপকে দিয়েও তারা ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। মোটকথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভারতবিরোধী অবস্থান জোরদার করছে চীন। ভারতবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে তারা নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলা, বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে চীনের দিক থেকে সেরকম তীব্র সক্রিয়তা দেখা যায়নি। এমনকি ভারতবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি চীনা সমর্থন পাচ্ছে, এমন কোনো ইঙ্গিতও মেলে না।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে ছেড়ে দেয়ার পর চীন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পথে হাঁটলেও বাংলাদেশে ভারতের নিয়ন্ত্রণ তারা চলতে দিয়েছে মসৃণভাবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে চীন ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যা কিনা ভারতের সঙ্গে সমঝোতার ইঙ্গিত বহন করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়াদিতে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে চীনকে এখন পর্যন্ত মুখ খুলতে দেখা যায়নি। চীনের জানা যে, তার সবচেয়ে বড় উচ্চাভিলাষী বাণিজ্য পরিকল্পনা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প কখনই পূর্ণ গতি পাবে না, যদি ভারত তাতে বিরোধিতা অব্যাহত রাখে। তাই দেশটির কৌশলী নেতৃত্ব ভারতকে কাছে টানতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারাও বাংলাদেশকে বিক্রি করেছে, টোপের খাবার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
এসবের ফল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাতন্ত্রের ‘মক্কা’ হয়ে উঠেছে ভারত। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও দেখা গেছে রাজনৈতিক দলগুলো আশীর্বাদ নিতে ভারতে ছুটছে। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপির প্রতিনিধিরা ভারত সফর করেছে। ভারতের সরকার ও সেখানকার অনেক থিংকট্যাংক গ্রুপের সঙ্গে মতবিনিময় করে তারা। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কামনা করা হয় অব্যাহত সমর্থন। আর বিরোধী বিএনপি চায় ভারত তাদের শত্রু মনে না করে পাশে দাঁড়াক।
১৪ জুন, ২০১৮ অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রিকে উদ্ধৃত করে। তিনি বলেন,
‘দেখুন, কূটনীতিতে নাথিং ইজ স্ট্যাটিক। আজ বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসে এবং ভারতের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, আমি নিশ্চিত দিল্লিতে যে কোনো সরকারই তা গ্রহণ করবে। তবে, তার আগে বিএনপিকেও দেখাতে হবে যে, কোনো মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে তাদের আঁতাত নেই এবং অতীত ভুলে তারাও সত্যিই ভারতের সঙ্গে নিখাদ বন্ধুত্বই চায়।’
মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভারতীয় কর্তারা তাদের ‘নির্ধারক’ অবস্থান সম্পর্কে অবগত। তারা বাংলাদেশে কী দেখতে চান তা জানাচ্ছে এবং সেজন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তও বেঁধে দিয়েছে। এই ভূমিকাটাই প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা। বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে সম্ভব নয় ভারতে সাধারণ নির্বাচনের আগে সেখানকার পক্ষগুলোকে ডেকে পাঠানো এবং তাদের নসিহত করা। কিন্তু ভারত এটা করেছে এবং এ দেশের দলগুলো তাদের এই আধিপত্য শুধু মেনেই নেয়নি বরং কে আনুকূল্য পাবে সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়েছে। ফলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার ভারতের জন্য আরও সহজ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ অবশ্যই ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ, যেমন বাংলাদেশের জন্য ভারত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের এই দেশটি ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের একমাত্র উপায়। ফলে ভারতের শাসকশ্রেণি বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার পক্ষপাতি এবং সেটা তারা চালিয়েও যাচ্ছে। তবে ভারত কেবল সীমান্তবর্তী একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে তার জন্য নিরাপদ করতে চাইছে না, বরং সে দেশের পুঁজিপতিরা আর্থিকভাবে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ মুনাফা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছে।
বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম মূল্যমানের পণ্য। এর মাধ্যমে ২০২১ সালে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে ভারতের ৪র্থ বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। প্রতিবেশী সব দেশ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে বেশি রপ্তানি করে ভারত। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন ভারতীয়দের অন্যতম গন্তব্য। পাঁচ লাখের বেশি ভারতীয় প্রতি বছর ৪৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে প্রেরণ করে বলে খবরে এসেছে।
ভারতের অনেক হাসপাতালের বাংলাদেশে এজেন্ট আছে। এখান থেকে রোগী সংগ্রহ করার জন্য অনেক হাসপাতাল পরিকল্পনামাফিক বাংলাদেশ টিম পাঠিয়ে থাকে। বাংলাদেশী রোগীদের ভারত গমনের হার কারো অজানা থাকার কথা নয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতও দুর্বল অবস্থায় চলে গেছে এবং তার ফলাফল পাচ্ছে ভারত। উচ্চশিক্ষা থেকে প্রাথমিক, বাংলাদেশের সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের একাংশের গন্তব্য হয়ে উঠেছে ভারত।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অনেক উন্নত, অন্তত ভারতের তুলনায় তো বটেই। তবু বছর বছর উৎসবের মৌসুমে ভারতে পোশাক কিনতে বাংলাদেশীরা দলে দলে পাড়ি জমাচ্ছে। যা কিনা ভারতীয় প্রভাবের সামাজিক বিস্তারের অংশ।
বাংলাদেশের সিনেমার নায়ক-নায়িকারা এখন পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় অভিনয় করেন, তাদের সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোতে দেখানো হয়। ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো সারা বাংলাদেশেই দেখা যায়, এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের পণ্যের বিজ্ঞাপনও দেখানো হয় তাতে। অথচ ভারতে কোথাও বাংলাদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দেখানো হয় না। এমনকি বাংলাদেশি রিয়েলিটি শোগুলোও এখন বাতিলের খাতায়, ভারতীয় চ্যানেলে যাচ্ছে দেশী পারফর্মাররা।
বাংলাদেশের জ্বালানিখাত ভারতীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় ভারতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বেশি। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎখাতকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বিদ্যুৎ আমদানি ও দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনখাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্বে দেয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
ভারতীয় শাসকরা এ দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিজ বলয়ে রাখতে সব কিছুই করছে। শ্রমজীবী জনগণকে সুবিধাহীন অবস্থায় রেখে চরম শোষণ করে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া অর্থনীতির ফলে তারা ভাগ বসাচ্ছে। এখানকার পুঁজিপতিরা ও রাজনীতিকরা ভারতীয় শাসকদের জায়গা করে দিয়েছে। এতে করে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি তো বটেই, ভারতীয় আগ্রাসন এখন মনস্তত্ত্বের গভীরেও থাবা বসাতে পারছে। ভারতীয় শাসকরা যেন বাংলাদেশের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ভারতীয় দখল ও উপনিবেশিকীকরণের এই আশঙ্কা তীব্র ছিল। কিন্তু তখন না হলেও চার দশক পর এখন তা যেন পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করছে।
হামবুর্গ, ২২ জুলাই ২০২২
আপনার মতামত জানানঃ