কিছুদিন আগে মাহফুজ আনাম লিখেছিলেন, ‘পত্রিকার স্বাধীনতা এখন প্রশংসার স্বাধীনতায় পরিণত হয়েছে।’ যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্রশংসা চলতে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত পত্রিকা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই নিরাপদ থাকে। সমালোচনা ও বিকল্প মতবাদের প্রতি অসহিষ্ণুতা এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে যে, গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজকের বাংলাদেশে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমকে দুর্বল করার পাশাপাশি সংসদেও জনজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আলোচনায় স্থান পায় না। একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও সংসদে দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে কোনো বিতর্ক হয় না বললেই চলে। সারা বিশ্ব আজ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখোমুখি, বাংলাদেশ যার একেবারে অগ্রভাবে রয়েছে। কিন্তু আমাদের সংসদে এ বিষয়ে একবারও কোনো বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা হয়নি। শিক্ষা, তারুণ্য, নিয়োগ, পরিবেশ, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতিমালা, জঙ্গিবাদের হুমকি, মানবসম্পদের উন্নয়ন—যেকোনো জাতীয় সংকটপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করলেই দেখা যায়, আমাদের জাতীয় সংসদে সেই বিষয়ে কোনো ধরনের অর্থবহ আলোচনা হয়নি।
আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো—মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন শুধু সেগুলোই শুনতে পায়, যেটা তারা শুনতে চায়। বাকি সবকিছু বন্ধ করে রাখে। তবে, এ চর্চায় সবার থেকে এগিয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। সম্ভবত তাদের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনে ভোটারদের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা ক্ষমতাসীনদের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেই খুশি থাকে।
আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও লজ্জাজনক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘গুম’। প্রতি বছর ‘গুম’ সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যরা কান্নাজড়িত চোখে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ বা নিদেনপক্ষে কিছু প্রশ্নের উত্তর দাবি করেন। কিন্তু মানবাধিকার কমিশন এতে ভ্রুক্ষেপও করে না। সংবাদপত্রগুলো দুর্নীতির ওপর বিস্তারিত অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপায়, কিন্তু সেগুলো দুদককে আকর্ষণ করে না।
সবশেষ জ্বালানি সংকটে জাতীয় নিরাপত্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ উন্মোচিত হয়েছে, যেটি আমাদের সবার জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। তবে, এটি এমন একটি বিষয়, যেটি অনেকাংশে জনগণের যথাযথ পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকে। আমাদের সমগ্র জ্বালানি খাত, গ্যাসের উৎস খোঁজা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কুইক রেন্টাল, এলএনজি আমদানি, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ—এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সংসদের নজরদারি ও দুদকের তদন্তের আওতায় আসেনি।
বুধবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) রেকর্ড পরিমাণে তেলের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত কিছু অবিশ্বাস্য তথ্য প্রকাশ করেছে। যা থেকে জানা গেছে, তেলের দাম না বাড়ালেও চলতো। সরকারের এই একটি উদ্যোগ দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চরম হতাশার দিকে এবং শিল্পগুলোকে জ্বালানি ও পরিবহনের জন্য বাড়তি খরচের কারণে নিদারুণ সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু এগুলো কোন বিষয় না। কারণ আমরা, বাংলাদেশের মানুষ, বেহেশতে বাস করছি। হ্যাঁ, এটাই সত্য। আর এই সত্যটা বলেছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ এই বেহেশত ঘোষণার দিনই যখন অন্যান্য জিনিসের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিমের ডজন ১৩০ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৫ টাকা এবং ফার্মের মুরগির কেজি ২০০ টাকা হয়ে যায়।
সরকার স্বীকার করুক আর নাই করুক, নানা কারণেই তারা যে এখন চাপের মধ্যে রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে সামনে নির্বাচন, অন্যদিকে কালো টাকার ছড়াছড়ি, দুর্নীতি সীমাহীন, বাজার নিয়ন্ত্রণহীন, জ্বালানি তেলের ভয়াবহ উচ্চমূল্য, ডলারের গলাকাটা দাম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্য, মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের এখন নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ঠিক তখনি জীবন চালানোর জন্য শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে একেবারে পেরেশান করে তুলেছে।
এতসব চাপের মধ্যে থেকেও আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা কিন্তু রসিকতা করতে ছাড়ছেন না। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, তারা রসিকতা করছেন জনগণের সংকট নিয়ে। যেমন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বললেন, ‘প্রত্যেকের গায়ে জামাকাপড় আছে, খুব খারাপ আছি মনে করি না।’
অন্যদিকে জনগণের দুরবস্থা নিয়ে আরেক ধাপ বেশি রসিকতা করলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি অবলীলায় বলে বসলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় কেউ মারা যায়নি, মরবেও না।’ তাহলে কি কাদম্বীনির মতো এইবার জনগণকে মরেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা মরে নাই?
দ্রব্যমূল্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে, দরিদ্র মানুষতো বটেই মধ্যবিত্ত মানুষই এখন নামজপ করছেন। কারণ কারোরই আয় বাড়ছে না, বাড়ছে সংসার খরচ। এই আর্থিক কষ্ট মানুষের মনের ওপর যে চাপ ফেলছে, তা মৃত্যুর চাইতে ভয়াবহ। আমাদের মতো নির্ধারিত আয়ের মানুষের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো বাজারে সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়বে, আমার আয় বাড়বে না কিন্তু আমাকে খরচ কমাতে হবে। সাধারণ মানুষ এত হিসাব-নিকাশ বোঝে না। শুধু দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে, পরিবার নিয়ে নিরাপত্তার মধ্যে বাঁচতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে যখন অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হলো তেলের দাম, তখন মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মূল্যবৃদ্ধির জন্য কারও কোনো প্রস্তুতি ছিল না, ছিল না কোনো আলোচনা বা আগাম সতর্কতা।
দ্রব্যমূল্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে, দরিদ্র মানুষতো বটেই মধ্যবিত্ত মানুষই এখন নামজপ করছেন। কারণ কারোরই আয় বাড়ছে না, বাড়ছে সংসার খরচ। এই আর্থিক কষ্ট মানুষের মনের ওপর যে চাপ ফেলছে, তা মৃত্যুর চাইতে ভয়াবহ।
সরকার কি জানে না নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা আর্থিকভাবে কতটা সংকটপূর্ণ, সেটাতো সরকারের বিবেচনায় থাকা দরকার ছিল। কিন্তু, তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তাতে মনে হয় না যে তাদের এই বিবেচনাটা খুব একটা আছে। উল্টো সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এই মূল্যবৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ নিয়ে মজা করা হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয়দের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য একদিকে যেমন সরকারের ভাবমূর্র্তি নষ্ট করে, তেমনি মানুষকেও ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে।
এই আপৎকালীন সময়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বললেন, ‘আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিষ গিলল।’ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো বুঝতে হবে এই বিষ দেশের জনগণ গিলল। আইএমএফ-এর লোন কেন দরকার, কোথায় খরচ হবে, কীভাবে খরচ করবে, সুদ কত, সরকার কীভাবে-কতদিনে সুদ মেটাবে, জনগণকে কতটা বহন করতে হবে– এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা দরকার সরকারকেই, কারণ তা না হলে মেনন সাহেবের বিষ গেলার কথাটাই সত্য বলে ধরে নিতে পারে বিপদগ্রস্ত জনগণ।
২০১২ সালে আইএমএফ যখন বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল, তখনো তারা অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সরকারকে ২০১৩ সালে গোটা ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হয়েছিল। পাশাপাশি ৯ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত না দিলে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ হয়ে যাওয়াসহ ঋণ পুনঃতফশিলের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতিমালাও পরিবর্তন করতে হয়েছিল। (দ্য ডেইলি স্টার)
আইএমএফের ঋণ পুরোটা পাওয়ার পর সরকার আবার সেইসব নিয়মকানুন পরিবর্তন করে আগের জায়গায় চলে গিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে সুবিধা পেয়েছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। এই ছাড় দিয়ে দিয়ে চলতি বছরের জুনে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের পরনের কাপড় ও মৃত্যু হওয়া নিয়ে যখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন ঠাট্টা মশকরা করছেন, তখন জানা গেল দেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে।
কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্চ করতে দেখছি না সরকারের কোন কর্তৃপক্ষকে। অথচ এই এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের হিসাব, অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার এবং দেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সবই এক সুতোয় বাধা।
সুইস ব্যাংকে কার কত টাকা জমা হচ্ছে, অন্যান্য দেশ নিজের নাগরিকদের বিষয়ে এই তথ্য জানতে চেয়ে, জানতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ বলছে, তারা জানতে পারেনি। অন্যদিকে ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অ্যাকাউন্টের বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য চায়নি’ বলে সুইস রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার্ড বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যকে ‘মিথ্যা’ অভিহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? বাংলাদেশ কি আদতেই জানতে চাইছে সেখানে কার কত টাকা জমা হচ্ছে? সুইস ব্যাংকে রাখা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তিদের অর্থের পরিমাণ সম্প্রতি কমে থাকলেও সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। শেষপর্যন্ত হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন সুইস ব্যাংকে টাকার তথ্য চাওয়া হয়েছে কি না?
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ