সৌদি আরবে মালিক ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন চুনারুঘাটের এক তরুণী। তাই দেশে ফিরতে ভিডিও কলে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দেশে ফেরার সে আকুতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার তরুণী শিল্পী আক্তার চুনারুঘাট উপজেলার তৈইগাঁও গ্রামের আব্দুল মজিদের মেয়ে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণী কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মায়ের কাছে বলছেন, ‘তুমরার কাছে আমি ভিক্ষা চাই। আমারে দেশে ফিরাইয়া নেও। তিন বছর ধইরা আমারে আটকাইয়া রাখছে। আমারে ধরে-মারে। মালিকে মারে, মালিকের পুলা-পুইরে মারে। আমারে খানি দেয় না, একবার দিলে আরেকবার দেয় না। ঘরের ভেতরে তালা মাইরা রাকে। দেশে ফিরাইয়া না নিলে আমারে মাইরালাইব, লাশ কইরা বাংলাদেশে পাঠাইব।’
শিল্পীর মা নূরচান বিবি জানান, ২০১৯ সালের এপ্রিলে সৌদি আরব যায় তার মেয়ে শিল্পী আক্তার। সেখানে যাওয়ার পর একটি বাসায় গৃহকর্মীর চাকরি নেয় সে। কিন্তু সেই বাসাটি সৌদি আরবের কোন এলাকায় সেটি নিশ্চিত নন তিনি।
সেখানে যাওয়ার পরই তার ওপর চলে নির্যাতন। কাজে ছোটখাটো ভুল হলেই মারধরের শিকার হয় শিল্পী। প্রতিনিয়ত তাকে শারীরিক নির্যাতন করেন বাসার মালিক ও তার ছেলেমেয়েরা।
প্রথমে মা-বাবা ও অসচ্ছল পরিবারের কথা চিন্তা করে সব নির্যাতন নীরবে সহ্য করে শিল্পী। কথা ছিল দুই বছর সেখানে থাকার পর ২০২১ সালের এপ্রিলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু দুই বছর অতিক্রম হলেও তাকে দেশে পাঠানো হয়নি। উলটো ভিসার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। দেশে আসার কথা বললে শিল্পীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে বর্তমানে শিল্পী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
নূরচান বিবি বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাই। কিন্তু তারা আমার মেয়েকে দিচ্ছে না। ট্রাভেলসের লোকেরাও আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছে না।’
শিল্পীর বাবা বলেন, সংসারে অভাবের কারণে মেয়েকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলাম। এখন আমার মেয়ে খুব কষ্টে আছে। আমি আমার মেয়েকে ফিরে চাই।’
তিন বছর ধইরা আমারে আটকাইয়া রাখছে। আমারে ধরে-মারে। মালিকে মারে, মালিকের পুলা-পুইরে মারে। আমারে খানি দেয় না, একবার দিলে আরেকবার দেয় না। ঘরের ভেতরে তালা মাইরা রাকে। দেশে ফিরাইয়া না নিলে আমারে মাইরালাইব, লাশ কইরা বাংলাদেশে পাঠাইব।’
ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকার ফোর সাইট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডর মাধ্যমে সৌদি আরব গিয়েছিলেন শিল্পী।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক খালেদ হোসাইন বলেন, আমরা তাকে (শিল্পী) দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে এক মাস আগে অভিযোগ দিয়ে রেখেছি। আশা করি দ্রুত তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারব।
শিল্পী আক্তার সৌদি আরবের কোথায় কাজ করেন, এ প্রশ্নে তিনি জানান, সে সৌদি আরবের রিয়াদে কাজ করে। শারীরিক নির্যাতন ও ফিরে আসা প্রসঙ্গে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
হজের আশ্বাসে সৌদি নিয়ে নির্যাতন
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান কনকর্ড এ্যাপেক্স রিক্রুটিং এজেন্সি এ পর্যন্ত আড়াই হাজার নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দরিদ্র নারীদের টার্গেট করে ভালো বেতন ও বিনামূল্যে হজ করার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর প্রতিশ্রুতির কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা হতো না। বরং বিভিন্ন অবৈধ কাজে বাধ্য করা হতো।
সম্প্রতি কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর পল্টন থানার সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে কনকর্ড এ্যাপেক্স রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক আবুল হোসেন ও তার সহযোগী আলেয়া বেগমকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে সোমবার(০৮ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।
র্যাব জানায়, অভিযানের সময় সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্স থেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য আনা তিন নারীসহ ৩১টি পাসপোর্ট ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে মানব পাচারকারী চক্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র ও সহজ-সরল মানুষ। তাদের লোভনীয় বেতনে চাকরিসহ সৌদি আরবে বিনামূল্যে হজ পালন করার প্রলোভন দেখানো হতো। কিন্তু বিদেশে নিয়ে বিভিন্ন অবৈধ কাজে বাধ্য করাসহ নির্যাতন করা হতো।
দীর্ঘদিন ধরে বৈধ প্রতিষ্ঠান কনকর্ড রিক্রুটিং এজেন্সির আড়ালে নারী পাচার ও নির্যাতনের মতো অপকর্ম করে আসছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন আবুল হোসেন। তার এ কাজের অন্যতম সহযোগী আলেয়া বেগমসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য দালাল রয়েছে।
দালালদের মাধ্যমে তিনি মূলত সমাজের বেকার, অল্পশিক্ষিত, অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারগুলোর তালাকপ্রাপ্ত ও অসহায় নারীদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে অধিক বেতনে চাকরি, বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা, রাজকীয় থাকা খাওয়া সুবিধা, স্মার্টফোন নেওয়া এবং সৌদিতে হজ করানোর মতো ধর্মভিত্তিক লোভনীয় কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠাত। বিদেশে যাওয়ার পর প্রথমে তারা ভুক্তভোগীদের জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রাখত এবং পরবর্তীতে ২ থেকে ৩ দিন পর বিভিন্ন ব্যক্তির বাসায় পাঠাত।
বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর তাদের দ্বারা সব ধরনের কাজ করানো হতো। কিন্তু ঠিক মতো খেতে দেওয়া হতো না। অকারণে বেধরক মারধরের মাধ্যমে অমানবিক নির্যাতন করা হতো। এমন কি বিদ্যুতের শক দেওয়া হতো।
এই চক্রের অন্যতম দালাল হিসেবে কাজ করা আলেয়া আগে পল্টন এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংগ্রহের কাজ করেছেন। ২০২১ সাল থেকে আবুল হোসেনের কনকর্ড রিক্রুটিং এজেন্সিতে শ্রমিক সংগ্রহের কাজ শুরু করেন তিনি। বিদেশে পাঠানোর আগে এসব শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিভিন্ন সাদা কাগজে সই নেওয়াসহ আরও নানা ধরনের কাজ করতেন আলেয়া।
অভাব-অনটন বেশি থাকা এবং আয়-উপার্জনের সুযোগ কম থাকায় প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তারা যান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে এবং গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা কেন? ২০১৯ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? সম্ভবত না। আর সে কারণেই নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা নারী কর্মীর সংখ্যা শুধু বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও সরকার করে না। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১১
আপনার মতামত জানানঃ