বকেয়া বেতন চাইতে গেলে মিথ্যা অভিযোগ তুলে গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে উল্টো পুলিশে দিয়েছেন বরগুনার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা। গৃহকর্মী রাসেল মুন্সীর বিরুদ্ধে মোবাইল ফোনে কথোপকথন রেকর্ড করার অভিযোগে তুলে এমপি এ নির্যাতন চালান।
রাসেল মুন্সীর বাবা জাকির মুন্সী জানান, ১১ মাসের বকেয়া বেতন চাইতে তিনি ছেলেকে নিয়ে গতকাল বুধবার সকালে এমপির বাসায় যান। এরপর মিথ্যা অভিযোগ তুলে তার ছেলেকে নির্যাতন করে পুলিশে দেওয়া হয়।
পাথরঘাটা থানার ওসি আবুল বাশার গৃহকর্মী রাসেল মুন্সীকে আটকের কথা স্বীকার করে জাতীয় দৈনিক সমকালকে জানান, ওই গৃহকর্মীর ফোন পরীক্ষা করেও কথোপকথনের রেকর্ড পাওয়া যায়নি। এমপির সঙ্গে আলোচনা করে রাসেলের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাকির মুন্সী আরও জানান, বরগুনা-২ (পাথরঘাটা-বেতাগী-বামনা) আসনের সাবেক এমপি গোলাম সবুর টুলু জীবিত থাকাকালীন কালমেঘা গ্রামে তাদের বাড়িতে তিনি কেয়ারটেকার হিসেবে পুরো পরিবার নিয়ে থাকতেন। তখন তার ১১ মাসের বেতন বকেয়া পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় এমপি টুলু মৃত্যুবরণ করার পর তার পরিবারের কাছে একাধিকবার চাওয়া হলেও তারা বকেয়া বেতন দেননি।
জাকির মুন্সীর অভিযোগ, সাবেক এমপি গোলাম সরোয়ার হিরুকে বকেয়া বেতনের কথা জানানোয় এমপি নাদিরা ক্ষুব্ধ হন। গতকাল সকাল ১১টার দিকে তিনি ছেলে রাসেলকে নিয়ে এমপির পৌর শহরের বাসায় যান। এ সময় কথাবার্তা মোবাইলে রেকর্ড করছে এমন অভিযোগ তুলে রাসেলকে আটক করে মারধর করা হয়। পরে ওসিকে ডেকে আনলে তিনি রাসেলকে থানায় নিয়ে যান।
১১ মাসের বকেয়া বেতন চাইতে তিনি ছেলেকে নিয়ে গতকাল বুধবার সকালে এমপির বাসায় যান। এরপর মিথ্যা অভিযোগ তুলে তার ছেলেকে নির্যাতন করে পুলিশে দেওয়া হয়।
গোলাম সরোয়ার হিরু বলেন, কয়েক মাস আগে জাকির মুন্সী বেতন বকেয়া থাকার অভিযোগ জানাতে তার কাছে গিয়েছিলেন। তিনি বিষয়টি এমপি নাদিরা সুলতানার মেয়ে রুমকিকে বলেন। এরপরও সমাধান না হওয়ায় তখন ঢাকায় অবস্থানরত এমপি নাদিরা সুলতানার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তখন এমপি নাদিরা তাকে কথা দিয়েছিলেন- পাথরঘাটায় ফিরে বিষয়টি মিটমাট করে দেবেন।
এ বিষয়ে জানতে এমপি নাদিরা সুলতানার মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি বরগুনাতে আছেন, পরে কথা বলবেন বলে জানান। প্রায় ১৫ মিনিট পরে তার ব্যক্তিগত সহকারী শহিদুল ইসলাম ফোনে জানান, এমপি গোলাম সবুর টুলু মারা গেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। এত বছর পর বকেয়া বেতনের দাবি জাকির মুন্সীর ভাঁওতাবাজি।
গৃহকর্মীদের অধিকার নিশ্চিত ও নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ’ নীতিমালা প্রণয়ন করলেও নেই এর বাস্তব প্রয়োগ। ৬ বছর থেকেই নীতিমালাটি আটকে আছে নীতির বৃত্তেই। নীতিমালাকে আইনে পরিণত করতেও নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ। ফলে একদিকে যেমন গৃহকর্মীরা পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না, অপরদিকে তারা নানাভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হলেও অধিকার ও সুবিচার পাচ্ছে না। কর্মস্থলে যেন ‘ক্রীতদাস’ হয়েই দিন কাটছে তাদের।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গৃহকর্মীর নির্যাতন প্রতিরোধে আইন না থাকায় একের পর এক গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় বিচারহীনতা, বেতন ঠিক না থাকা, ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ঘটনা যেমন আছে, আইন না থাকায় তেমনই অনেক ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হতে হয় গৃহকর্তাকেও।
গৃহকর্মীদের শ্রমকে ‘শ্রম’ হিসেবে ধরা হয়নি শ্রম আইনেও। শ্রমিক হিসেবে তাদের নেই কোনো আইনগত স্বীকৃতি। কাজের জন্য নির্ধারিত নেই কোনো কর্মঘণ্টা। নেই বেতন কাঠামো। সাপ্তাহিক ছুটি বা অবসর নেই। এমনকী ঘুমানোর কোনো নির্দিষ্ট স্থানও নেই। সামান্য ত্রুটিতে মারধর, ঠিকমতো খাবার না দেয়া, বেতন কম দেয়া, বাড়িত যেতে না দেয়ার অভিযোগ তো আছেই।
তারা আরও বলেন, গৃহকর্মীরা নির্যাতিত হলে কিন্তু নারী শিশু নির্যাতন আইনসহ বিভিন্ন আইনে মামলা করে বিচার চাইতে পারেন। তবে তাদের বেতনের নিশ্চয়তাসহ সকল অধিকার নিশ্চিতের জন্য একটি আলাদা আইন দরকার। তবে শুধু আইন করলেই চলবে না; যথাযথভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৯
আপনার মতামত জানানঃ