স্ত্রীকে বিদেশে পাচারের দায়ে স্বামীকে তিন বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন রাজশাহীর একটি আদালত। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে (৩০ জুন) রাজশাহীর মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক লিয়াকত আলী মোল্লা এ রায় দেন।
সাজাপ্রাপ্ত স্বামীর নাম মাসুম পারভেজ রুবেল (৩২)। তাকে তিন বছর সশ্রম কারাদন্ড ছাড়াও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ সালের ৮ ধারায় এই সাজা দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম রেন্টু।
তিনি জানান, আসামী মাসুদ পারভেজ ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তার স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জননীকে ভুল বুঝিয়ে সৌদি আরবে পাচার করে দেয়। সেখানে ভিকটিম বিভিন্ন সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন শেষে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি দেশে ফিরেন। সে বছর ২৩ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলায় চারজনের স্বাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এই রায় ঘোষণা করেন।
শফিকুল ইসলাম রেন্টু বলেন, কথা ছিল স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিদেশ যাবেন। বিমানবন্দরে ঢুকে স্বামী স্ত্রীকে বললেন, তিনি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছেন। এই বলে বাইরে গিয়ে আর ফেরেননি। দালালের মাধ্যমে স্ত্রী চলে যান সৌদি আরব। তখনো বুঝতে পারেননি তার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে! সৌদি আরব যাওয়ার পর ওই নারীকে গৃহকর্মীর কাজে লাগানো হয়। চালানো হয় যৌন নির্যাতন।
মাসুম পারভেজের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার একটি গ্রামে। তিনি ঢাকায় রিকশা চালাতেন। আর তার স্ত্রী কাজ করতেন পোশাক কারখানায়।
মাসুমের স্ত্রীর ভাষ্য, ২০১৭ সালে তার স্বামী বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলেন। নিজের পরিবারের সুখের কথা ভেবে তিনি তার মায়ের জমি বন্ধক রেখে ও গরু বিক্রি করে স্বামীর হাতে ৪ লাখ টাকা তুলে দেন। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর স্বামী মাসুম পারভেজ তাকে বিমানবন্দরে ঢুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়েন।
ওই নারী বলেন, মাসুম কেটে পড়ার পর দালালদের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরব পৌঁছান। সেখানে তাকে গৃহকর্মীর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। বেতন স্বামীকে পাঠানো হচ্ছে বলে তিনি কিছুই পেতেন না। এ কাজে তার আপত্তিও ছিল না। কিন্তু একপর্যায়ে তার ওপর উপর্যুপরি যৌন নির্যাতন চালানো শুরু হয়। আপত্তি করলেই গৃহকর্তার নির্যাতন সহ্য করতে হতো।
সৌদি আরবে পর্যায়ক্রমে তিনজন গৃহকর্তার বাড়িতে কাজ করতে হয় ওই নারীকে। প্রত্যেক বাড়িতেই একই ধরনের নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কয়েকবার স্বামীকে ফোন করে এসব জানিয়েছেন। সব শুনে তার স্বামী বলেছেন, জেনেশুনেই তিনি তাকে সৌদি আরব পাঠিয়েছেন।
ওই নারী বলেন, কোনো উপায় না দেখে তিন বছর পর তিনি গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে স্থানীয় পুলিশের হাতে ধরা দেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি ২ মাস ১৬ দিন কারাগারে ছিলেন। এরই মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পান। বাবা-মা টাকা পাঠালে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন।
সৌদি আরবে পর্যায়ক্রমে তিনজন গৃহকর্তার বাড়িতে কাজ করতে হয় ওই নারীকে। প্রত্যেক বাড়িতেই একই ধরনের নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওই নারী। তখন তিনি জানতে পারেন তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। সে পক্ষে বাচ্চাও আছে। এসব জানার পরও ওই নারী মাসুমের সংসারে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন। তখন মাসুম তাকে তালাক দিতে বলেন। না দিলে ওই নারীর বাবাকে হত্যার পাশাপাশি বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার হুমকি দেন। তখন বাধ্য হয়ে দেশে ফেরার আড়াই মাস পরে তিনি মাসুমকে তালাক দেন।
এরপর উল্টো মাসুমই ওই নারীর বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে তার স্ত্রীকে আটকে রাখার অভিযোগ এনে মামলা করেন।
এই নারী বলেন, এত নির্যাতনের পরেও তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাননি। কারণ তার মেয়েটি শ্বশুর–শাশুড়ির কাছে আছে। এদিকে মাসুম মামলা করার পর তিনি আর থেমে থাকেননি। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনিও রাজশাহীর মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে মাসুম পারভেজ ও তার ভগ্নিপতি জনাব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এই মামলা করার পর মাসুম তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। এতে ওই নারীকে বিদেশ পাঠানোর খরচ বাবদ ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দাবির পাশাপাশি নারীর বাবা-মাকে আসামি করা হয়। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে।
ভুক্তভোগী নারী বলেন, তার প্রত্যাশা ছিল, এই অপরাধে মাসুম পারভেজের আরও বড় সাজা হবে। তার ভগ্নিপতিরও সাজা হবে। কিন্তু ভগ্নিপতি খালাস পেয়েছেন। তবে তার আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেছেন, অপরাধ বড় হলেও মেয়েটির পক্ষে সাক্ষী পাওয়া যায়নি।
এখন এই নারী বলছেন, আদালতে দেখা হলে মাসুম পারভেজ হুমকি দিয়ে বলেছেন, জেল থেকে বের হয়েই তাকে দেখে নেবেন। অন্য কোথাও বিয়ে করলেও সংসার করতে দেবেন না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। এখন বাবা-মায়ের সংসারে আছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল করবেন সে টাকাও নেই। তার পাশে দাঁড়ানোরও কেউ নেই।
অভাব-অনটন বেশি থাকা এবং আয়-উপার্জনের সুযোগ কম থাকায় প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তারা যান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে এবং গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা কেন? ২০১৯ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? সম্ভবত না। আর সে কারণেই নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা নারী কর্মীর সংখ্যা শুধু বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও সরকার করে না। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।
অন্যদিকে, দেশে ফেরা এসব অভিবাসী নারী শ্রমিকের অনেককেই পড়তে হয় নতুন মানসিক চাপে। সমাজ এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হতে হয় তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীরা তাদের তালাক পর্যন্ত দেন আর অবিবাহিত নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয় শঙ্কা ও জটিলতা। ফলে সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো কতটা ভয়ানক তা সংশ্লিষ্টদের আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, এর আগেও এমন বিষয় উঠে এসেছে যে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীর সংখ্যা কমছে। আমরা বলতে চাই, স্বচ্ছলতার আশায় বিদেশ গমন করে নির্যাতিত হয়ে ফিরে এলে তা কতটা ভয়ানক সেটা অনুধাবন করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার, বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকের সুরক্ষা সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে উদ্যোগী হওয়া।
আরও বলেন, সর্বোপরি, আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ, ফলে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার বিষয়টি জরুরি। এ ক্ষেত্রে, নারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২০৮
আপনার মতামত জানানঃ