বিশ্বের সবদেশের নারীরাই কমবেশি সহিংসতার শিকার হন। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। করোনা মহামারির পর থেকে নারীর অবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠেছে।
দিন দিন বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা। পরিবার, সমাজ কোথাও রেহাই পাচ্ছেন না তারা। নারী নির্যাতন বলতে নারীদের ওপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বোঝায়।
যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এমনকি করোনাকালে সহিংসতা আরো বেড়েছে। করোনা সংকটের কারণে চলমান অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত পরিস্থিতিতে যেখানে নারীরা অধিক সহানুভূতি পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে থাকলেও ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আর্থিক সচ্ছলতার জায়গায় এখনো অনেকটা পিছিয়ে। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমছেই না। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন-নির্যাতন একটা বড় সমস্যা। আর্থিকভাবে অসচ্ছল নারীরা সহিংসতার শিকার হন বেশি।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দপ্তরের (ইউএনওডিসি) একটি গবেষণা এবং অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম (জেএনএনপিএফ) এক যৌথ গবেষণায়, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
উভয় গবেষণার ফলাফলেই বলা হয়েছে, নিজ ঘরেই নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার।
ইউএনওডিসির গবেষণার ফল অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিশ্বে মোট ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ খুন হয়েছেন একান্ত সঙ্গী অথবা পরিবারের সদস্যদের হাতে।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও জেএনএনপিএফের গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার দুই-তৃতীয়াংশই হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে। আর সহিংসতার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির পর্যায়ে যায় না বা গেলেও বাতিল হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিজের ঘর বা বাড়ি, অথচ সেখানেও নারীরা নিরাপদ নয়। নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশে বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন এবং তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর দ্বারা।
২০১৭ সালে বিশ্বে মোট ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ খুন হয়েছেন একান্ত সঙ্গী অথবা পরিবারের সদস্যদের হাতে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন, নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন, সহিংসতা এটি পুরো মানবজাতির জন্য একটা প্রকট সমস্যা। আমাদের মতো দেশে যেখানে নারীরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সেখানে হয়তো এটি বেশি ঘটে। নারীরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে ধীরে ধীরে সহিংসতা কমে আসবে। বর্তমান সরকারপ্রধান নারী হওয়ার ফলে গ্রামেগঞ্জে নারী নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে।
প্রতিরোধে নানা আইন ও নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু সেসব আইন ও নীতিমালা যে খুব একটা কাজে আসছে, তা-ও নয়। তবে এটা পরিষ্কার যে, শুধু আইন করে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। মূল সমস্যা হচ্ছে নারীর প্রতি সমাজের দীর্ঘদিনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
অ্যাকশনএইড ও জেএনএনপিএফের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, দেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলোর প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটিই আদালতে উত্থাপিত হতে দুই বছর সময় লেগে যায়। তারপর বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ধরনের সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরি বলেন, গত মার্চে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ইন্ডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫টি দেশের মধ্যে ৬৫তম। ২০১৫ সাল থেকে চারটি সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা—এ দুইটি ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গত বছর ১ হাজার ৪১১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। নারীর প্রতি এসব নির্যাতনের বড় কারণ হলো—পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। এ সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাক শিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে— বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্পসংখ্যক নারীর মধ্যেই।
নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এরপরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি দিনে দিনে মানবসমাজে নতুন অপরাধের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। যার অন্যতম উদাহরণ ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ বা নারী নির্যাতন। বর্তমানে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতন ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ইদানীং ব্যাপক আকারে বেড়েছে। এ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এর কোনো প্রতিকার হবে না।
সমাজে নারীদের প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত হতে হচ্ছে। প্রাচীন আমলের বিভিন্ন সামাজিকপ্রথা, কুসংস্কার এমনকি লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে নারী এখন পুরুষের পাশাপাশি পথ চলতে শুরু করেছে। কিন্তু এসময়ে এসেও পথেঘাটে, বাস-ট্রেনে এমনকি বাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপকহারে নির্যাতিত হচ্ছে।
নারীর ওপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সম্প্রতি এই নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই পাওয়া যায় একাধিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর। পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে।
তারা বলেন, নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি। কিন্তু এগুলোর তেমন কোনো বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাই প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। কথা বলতে হবে নিজ অধিকার আদায়ে।
এ সমস্যা মোকাবিলায় নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়া দরকার। উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির দিক থেকে পুরুষেরও এগিয়ে আসা দরকার। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব শুধু পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশই নয় বরং ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের মূল দায়িত্বটা পালন করা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৮
আপনার মতামত জানানঃ