বর্তমান সময়ের আলোচিত ও মর্মস্পর্শী ঘটনা সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় জীবন খাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। মূল্যবান জীবনের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সম্পদ, ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। সড়ক দুর্ঘটনায় হাজারো পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মাসিক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সারাদেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ৪১৩ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৫৩২ জন। নিহতদের মধ্যে ৬৭ জন নারী ও ৫৮টি শিশু রয়েছে।
সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৮৪ জন। যা মোট নিহতের ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৩ দশমকি ২৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৩ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
একই সময়ে সাতটি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং পাঁচ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং দুই জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৮৪ জন (৪৪ দশমিক ৫৫ শত্যাংশ), বাস যাত্রী ২৩ জন (৫ দশমিক ৫৬ শত্যাংশ, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ১২ জন (২ দশমিক ৯০ শত্যাংশ), ইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ যাত্রী ৯ জন (২ দশমিক ১৭ শত্যাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-টেম্পু-লেগুনা) ৬৬ জন (১৫ দশমিক ৯৮ শত্যাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ১৭ জন (৪ দশমিক ১১ শত্যাংশ) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৬ জন (১ দশমিক ৪৫ শত্যাংশ) নিহত হয়েছে।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। এই বিভাগে ৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ১০৪ জন। সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে। ২২টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ জন।
একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। এ জেলায় ২১টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত। সবচেয়ে কম লালমনিরহাটে। এখানে ২টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, অক্টেবর মাসে ১৪৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত হয়েছিল। নভেম্বর মাসে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮৪ জন। এই হিসেবে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বর মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৯.৭২ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১০.১৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৩৩৪ জন।
এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৮৪ জন। যা মোট নিহতের ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাঙ্কিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩ হাজার ৭০১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ হাজার ৫০২ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৪৭৯ জন আহত হন। বাংলাদেশ পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২৪,০০০ মানুষ মারা যায় কিন্তু পুলিশের রেকর্ড করা তথ্যে এ সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে।
এক পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশেষ করে গত দুই দশকে মাথাপিছু সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তিনগুণ বেশি। এসব কারণে দেশে সেবছর ১১ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে জানায় তারা। সে বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ৫.৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তারা।
ট্রাফিক সপ্তাহ, ট্র্যাফিক পক্ষ, র্যাব-পুলিশ তৎপরতা চলছে, চলছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চিহ্নিতকরণের কাজ। ওদিকে সতীর্থের অকাল মৃত্যুর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করছে। কিন্তু কিছুতেই সুফল মিলছে না। দুই বছর আগে ২০১৯ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের পরও সড়ক দুর্ঘটনা মোটেও কমেনি। বরং বেড়েছে আর বাড়ছেই। আশা করা গিয়েছিল, আন্দোলনের ফলে সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা, চালক এবং জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। এর ফলে কমবে দুর্ঘটনার হার। অত্যন্ত নিরাশ হয়ে বলতে হয়, এর কোনোটাই হয়নি। বড় বড় আন্দোলনও এক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি। সবকিছু যেমন চলছিল তেমনই চলছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনকে সঠিকভাবে কার্যকরের বিকল্প কিছু নেই। আমাদের নিজেদের স্বার্থে সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যেন একটি মূল্যবান প্রাণও সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে না যায়। একজন মায়ের বুকও যেন খালি না হয়। একজন নারীও যেন বিধবা না হয়। কোনো সন্তান যেন এতিম না হয়। আমাদের যেমন নিরাপদ সড়ক পাওয়ার অধিকার আছে, তেমন কিছু কর্তব্যও আছে। পথচারী, মালিক, চালক, হেলপার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজ নিজ জায়গায় থেকে সৎভাবে কর্তব্যগুলো পালন করে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াল অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারি। নিজ দায়িত্বে সচেতন হয়ে সুস্থ থাকি, অন্যকে এবং পরিবারকে নিরাপদ রাখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে সড়কে প্রাণ যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। সরকারের নানা বিভাগ, একেকজন একেক দিকে। কেউ সঠিক ভাবনা ভাবছে না। তাই যা হবার তাই হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া চালক ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
তারা বলেন, দিনের পর দিন এ অবস্থা তো চলতে পারে না। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তারা বলেন, মহাসড়কে গড়ে প্রতি মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে ওভারটেকিংএর চেষ্টা করে। একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গেলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা নেই বলেই দুর্ঘটনা। আর সরকারের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগও খুব একটা চোখে পড়ে না। সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখেমুখেই। বাস্তবে কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
তারা বলেন, আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় নতুন করে দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৭
আপনার মতামত জানানঃ