
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে সাম্প্রতিক এক বছর যেন এক বিপরীত বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘদিন বিরোধী রাজনীতির ধারা ধরে রাখা বিএনপি, বর্তমান ক্ষমতা শূন্য অবস্থায় এক অদ্ভুত রূপ নিচ্ছে মাঠপর্যায়ে। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত, দেশজুড়ে চার হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে তাদেরই সংগঠনকে। এর পেছনে যে বাস্তবতা কাজ করছে তা একাধিক স্তরে বিশ্লেষণ দাবি করে।
যুদ্ধপরবর্তী দেশগুলোর মতো, বাংলাদেশেও রাজনীতির শূন্যতা বা পরিবর্তনের পর নতুন একটি দল যখন নেতৃত্বের সম্ভাবনা তৈরি করে, তখন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে একপ্রকার “অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ” ও কর্তৃত্ব গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের পতনের পর ঠিক এমনটাই দেখা যাচ্ছে বিএনপির বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে। অনেকেই মনে করছেন, তারা যেন হঠাৎ করেই “সরকারি দলের” ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
এই বাস্তবতায় সংঘটিত হচ্ছে একাধিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড—যেমন থানায় হামলা, ধর্ষণের অভিযোগ, চাঁদাবাজি, ক্ষমতা প্রদর্শন, পুলিশ মারধর এমনকি বার ও রেস্টুরেন্টে হামলার মতো ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে—এ কি ক্ষমতার শূন্যতায় উদ্ভূত নতুন ‘ক্ষমতা-চর্চা’? নাকি বিএনপি নেতৃত্বহীনতায় পড়ে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দুই রকম সংকটের মিলিত ফলাফল। একদিকে, মাঠপর্যায়ে ক্ষমতা ও প্রতিশোধের মনোভাব—যা তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অবদমন এবং প্রতিক্রিয়াশীল উত্তেজনার ফলাফল হিসেবে। অন্যদিকে, তারেক রহমানের প্রবাসে অবস্থান এবং দলের সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়া—দুটিই এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানায় হামলা, ভোলায় ধর্ষণের ঘটনা, খুলনায় পুলিশের ওপর আক্রমণ—এই সবগুলোই প্রকাশ্যে এসেছে এবং মিডিয়ার নজরে এসেছে। বিএনপি বলছে, তারা প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, এমনকি অনেক সময় নিজেরাই মামলা করছে। তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—কেন এত বিস্তৃতভাবে এইসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে?
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “বিএনপি একটি বড় দল, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনার জন্য পুরো দলকে দায়ী করা যায় না।” যদিও এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা স্বীকারযোগ্য, কিন্তু চতুর্দিকে যখন অনিয়মের ঘটনা বাড়ছে, তখন এই বিচ্ছিন্নতার যুক্তি কতটা কার্যকর?
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং। স্থানীয় নেতৃত্বে ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক লোভ-লালসা—সবকিছুই একটি বিশৃঙ্খল মাঠ বাস্তবতা তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “সরকার নেই, তবে সুযোগ আছে”—এই মনোভাব থেকেই অনেকেই অপরাধে জড়াচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোস্তফা আল মামুন এই পরিস্থিতিকে “মজ্জাগত সাংগঠনিক সংকট” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বৃহৎ সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতর সর্বস্তরে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এটা বিএনপির ক্ষেত্রে আরও প্রকট, বিশেষত শীর্ষ নেতৃত্ব দেশে না থাকায়।
তবে এটাও ঠিক যে, অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনার শুরুতেই বিএনপিকে জড়িয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। যেমন মুরাদনগরের ধর্ষণের ঘটনার পরে তদন্তে দেখা যায়, অভিযুক্তদের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের আগেভাগে দায় চাপানোর প্রবণতা বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
একই সাথে অনেকে দেখছেন এটি একটি পরীক্ষার সময়ও—যেখানে বিএনপির নেতৃত্ব, ভবিষ্যতের ক্ষমতা কাঠামো এবং জনআস্থা সবকিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। দলে দলে বহিষ্কার, শৃঙ্খলা সভা, এবং প্রবাসী নেতৃত্বের নির্দেশনার প্রতি নির্ভরশীলতা দিয়ে কতদূর দল চালানো যাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি নতুন কোনো চিত্র নয়। কিন্তু যে নতুন বাস্তবতা এখন তৈরি হচ্ছে, তা একধরনের রাজনীতির রূপান্তর—যেখানে একটি দল সরকারে না থেকেও সরকারসুলভ আচরণ করছে, আর তাতে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সংকট: ‘অঘোষিত ক্ষমতার দায়’।
এই দায় বিএনপির নেতারা শুধু প্রশাসনের ঘাড়ে চাপিয়ে মুক্তি পাবে কি? নাকি দলকে সঠিক পথে আনতে, চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে এবং জনমতের আস্থাকে ধরে রাখতে তারা সত্যিকারের সংস্কারের পথে হাঁটবে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তরই হয়তো নির্ধারণ করবে, বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক কেমন হবে।
আপনি চাইলে এটিকে আরও ছোট করে বা বড় করে ব্যবহার করতে পারেন কোনো ম্যাগাজিন, ফিচার বা মতামত কলামের জন্য। প্রয়োজনে আমি আরও তথ্য যোগ করতে পারি।
আপনার মতামত জানানঃ