বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় ইউটিউব টকশো ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’-এ তিনি প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন, ইসলামি আন্দোলন যদি দেশের শাসনক্ষমতায় আসে, তবে তারা আফগানিস্তানের মতো একটি শরিয়া-ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন করতে চায়। এই ঘোষণায় দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে শুরু হয়েছে বিস্তর আলোচনার ঢেউ।
টকশোতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের প্রশ্নে ফয়জুল করীম বলেন, ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করা তাঁদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ সময় তিনি সোজাসুজি বলেন, “হ্যাঁ, আমরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো বানাতে চাই।” এই বক্তব্যে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশে হয়তো তালেবান শাসনের মতো এক কট্টর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়বে।
তবে ফয়জুল করীমের বক্তব্য ছিল কিছুটা ব্যাখ্যা-সমৃদ্ধও। তিনি দাবি করেন, শরিয়া আইন মানেই সব ধর্মের মানুষের অধিকার হরণ নয়। বরং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। হিন্দুদের অধিকার থাকবে বলে জানান তিনি। আবার ইরান, আমেরিকা, রাশিয়া বা ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় দর্শনের মধ্যেও যদি শরিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন কিছু পাওয়া যায়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
এই বক্তব্যে একটি দ্বৈত চিত্র ফুটে ওঠে—একদিকে আফগান-মডেল শরিয়া রাষ্ট্র, অন্যদিকে পশ্চিমা রাষ্ট্রের উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের উদারতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিকভাবে কতটা বাস্তবসম্মত কিংবা আদর্শিকভাবে কতটা টেকসই, সে নিয়ে এখন আলোচনা শুরু হয়েছে দেশের রাজনৈতিক মহলে।
এই আলোচনার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট রয়েছে। ঢাকার সাম্প্রতিক এক মহাসমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠতা দেখা গেছে। যদিও দু’টি দল অতীতে একে অপরের প্রতি তীব্র সমালোচনা করে এসেছে। পুরোনো এক ভিডিওতে ফয়জুল করীমকে বলতে শোনা গেছে—”ইসলাম ধ্বংস করতে জামায়াতই যথেষ্ট”। অথচ এখন সেই জামায়াতের নেতারাই একই মঞ্চে! বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ফয়জুল করীম অবশ্য সাফ জানিয়েছেন, আদর্শগত অবস্থান থেকে একচুলও সরেননি। একমঞ্চে থাকা মানেই সব বিষয়ে ঐকমত্য নয়। বরং নির্দিষ্ট বিষয়ে ঐক্য হলেই জোট গঠন সম্ভব বলে তার যুক্তি। এখানেও একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা স্পষ্ট—যথাসম্ভব ইসলামী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার প্রচেষ্টা।
তবে এই ঐক্যচেষ্টার মধ্যে বিএনপিকে দেখা যায়নি। ফয়জুল করীম বলেন, পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) ভোট পদ্ধতি নিয়ে যেসব দল একমত, কেবল তাদেরই দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করায় তাদের ডাকা হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যদি বিএনপি একমত হয়, তবে তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে বলে জানান তিনি।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তবে তিনি এটিকে ব্যক্তিগত ক্ষোভ বলে মানেন না। বরং জনগণের অসন্তোষের প্রতিফলন হিসেবেই এসব বক্তব্য দিয়েছেন বলে দাবি করেন। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, দলাদলি ইত্যাদিকে দায়ী করেন তিনি।
সবশেষে তিনি একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে কথা বলেন—মাজার ভাঙা। অন্তর্বর্তী সরকার আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘তৌহিদি জনতা’র নামে শতাধিক মাজার ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, মাজার খারাপ কিছু নয়, তবে কেউ সেখানে সেজদা করলে তাকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। মাজার ভাঙা ইসলামসম্মত নয় বলে তিনি মত দেন।
এই ফয়জুল করীমের বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে যেমন আলোচিত, তেমনি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বলয়ের জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথায় শরিয়া রাষ্ট্রের রূপরেখা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি উদারতা ও বাস্তববোধের দৃষ্টান্তও মিলেছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—বাংলাদেশ কি আদৌ আফগানিস্তানের মতো হতে চায়? যে দেশ একাত্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই দেশ কিভাবে এক ধর্মভিত্তিক শাসনের দিকে যেতে পারে?
এটি নিছক একটি ইসলামী দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নাকি আগামী নির্বাচনে একটি বৃহত্তর ইসলামী জোট গঠনের সূচনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামী আন্দোলন, জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ ইসলামপন্থী দলগুলো এক প্ল্যাটফর্মে এলেও তাদের ভেতরের আদর্শিক বিভাজন এখনো গভীর। তাই এই একতাবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া কতটা টিকে থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে।
তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামী আদর্শভিত্তিক আলোচনার কেন্দ্রস্থলে এখন রয়েছেন মুফতি ফয়জুল করীম। তাঁর বক্তব্য, অবস্থান এবং রাজনৈতিক কৌশল আগামী নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
আপনার মতামত জানানঃ