বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের হৃৎপিণ্ড, বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিডনির নানা জটিল অসুখও। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই খবর দিয়েছে।
আমেরিকান সোসাইটি অব নেফ্রোলজির (এএসএন) ‘কিডনি উইক ২০২১’ শীর্ষক অনলাইন সম্মেলনে ৪ নভেম্বর গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় ইংরেজি গণমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ইকোনমিক টাইমসসহ কয়েকটি সংবাদপত্র।
গবেষকরা দেখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছেন এমন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে। এই গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণ দেহে বাড়লেই হৃৎপিণ্ডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর সেই ক্ষত কিছুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস’।
মূল গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হাফসা তারিক বলেছেন, ‘যখনই আমাদের হৃদযন্ত্রে ফাইব্রোব্লাস্ট নামে একটি বিশেষ ধরনের কোষ কোলাজেন তৈরি করতে শুরু করে, তখনই হয় মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস। তার ফলে নানা ধরনের হৃদরোগ হয়। ডেকে আনে মৃত্যু।’
গবেষকরা দেখেছেন, বাতাসে বিশেষ ধরনের দূষণ কণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) পরিমাণ বাড়লেই এটা হচ্ছে। সেই কণা বাতাসে কম থাকলে বা একেবারে না থাকলে কিডনি, হৃৎপিণ্ডের ততটা ক্ষতি হচ্ছে না। খুব ক্ষতি হচ্ছে কিডনিরও। গবেষকরা দুবছর ধরে প্রায় দেড় হাজার রোগীর উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে এই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন।
নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়৷
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে।
সংস্থাটির মতে, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছেন এমন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে। এই গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণ দেহে বাড়লেই হৃৎপিণ্ডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর সেই ক্ষত কিছুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নগরায়ন ও শিল্পায়নের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুষঙ্গ হিসেবে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ সংস্থাটির নির্ধারিত মান মাত্রার নির্মল বায়ু সেবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্য বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ প্রকট আকার ধারণ করছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার ২০২০ সালের বিশ্বের বায়ুর মানের ওপর ভিত্তি করে জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা পরিচালনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম, শিল্প কারখানার উন্মুক্ত নিঃসরণ ও যানবাহনের ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, কঠিন বর্জ্য ও বায়োমাস পোড়ানো বায়ুদূষণের মূল কারণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চললেও কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে পরিবেশবিদদের। ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সকাল-বিকাল পানি ছিটানো হলেও আশানুরূপ ফল দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর কাজে সার্বক্ষণিক তদারক এবং বাতাসের মান স্বাভাবিক ও জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দূষণের মাত্রা যেভাবে বেড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাড়ির কালো ধোঁয়া কমানো ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতে হলে মোটাদাগে যানবাহন, নির্মাণ শিল্প ও কল-কারাখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর মধ্যে বায়ুদূষণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সারা দেশকে দূষণের জন্য বিবেচনা করা হলেও রাজধানীর দূষণ এ সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা। বর্তমান সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দূষণকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৩
আপনার মতামত জানানঃ