সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের তালিকায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার ওপরে। আর রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকার অবস্থান ছিল বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়। গতকাল ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৩’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। তালিকায় বাংলাদেশের পরেই রয়েছে পাকিস্তান ও ভারত। আর দূষিত রাজধানীর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারতের নয়াদিল্লি।
পরিবেশবিদরা বলছেন, দূষণ কমাতে হলে সরকারকে অবিলম্বে দায়ী খাতগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব নয়।
আইকিউএয়ারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী ৩০ হাজারের বেশি স্টেশনের মাধ্যমে বিশ্বের ১৩৪টি দেশের ৭ হাজার ৮১২টি স্থানের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৩ তৈরি করেন আইকিউএয়ারের বিশেষজ্ঞরা।
বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান ‘পিএম ২.৫’ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি হিসাব করেই মূলত বায়ুমান নির্ণয় করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এ অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া যাবে না।
আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ডব্লিউএইচওর বেঁধে দেয়া মানদণ্ডের প্রায় ১৬ গুণ। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তানে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৭৩ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম, যা ডব্লিউএইচওর বেঁধে দেয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৪ গুণ।
ভারতে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৫৪ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম। বায়ুদূষণের তালিকায় চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে তাজিকিস্তান ও বারকিনা ফাসো।
বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানটির ২০২২ সালের প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। ওই বছর বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৬৮ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ঘনমিটারে ক্ষতিকর এ বস্তুকণার পরিমাণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বায়ুদূষণে বাংলাদেশ যেভাবে শীর্ষে উঠে এসেছে, তাতে এটা বলাই যায় যে বাংলাদেশ একটা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। এ দেশের নাগরিকদের জীবনের অধিকারকে কেন যেন তোয়াক্কাই করা হয় না।
দেশে বায়ুদূষণ বিধিমালা হলো, আদালত থেকে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা দেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশও দিল। সরকার জানেও কোন কোন উৎস থেকে বায়ুদূষণ হয়, তার পরও সেগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। সরকারকে অনতিবিলম্বে দূষণকারী খাতগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার আর কতদিন নির্লিপ্ত থাকবে আমি জানি না। তবে আজ যে রিপোর্ট এসেছে, এরপর সরকারের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই।’
আইকিউএয়ারের এবারের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত বছর বিশ্বের সাতটি দেশের বায়ুমান ডব্লিউএইচওর বেঁধে দেয়া মানদণ্ডের মধ্যে ছিল। দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রানাডা, আইসল্যান্ড, মরিশাস ও নিউজিল্যান্ড।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এবার বায়ুদূষণের শীর্ষ ১০ শহরের অধিকাংশই মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার। এর মধ্যে ভারতের বিহার রাজ্যের বেগুসরাই শহরের বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ। সেখানকার প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ১১৮ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ডব্লিউএইচওর বেঁধে দেয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ২৩ গুণ। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে আসামের গুয়াহাটি। এ শহরে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ১০৫ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম।
টানা চতুর্থবারের মতো রাজধানী হিসেবে বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারতের নয়াদিল্লি। সেখানে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৯২ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঢাকায় এ বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। তালিকায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বারকিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাদুগু, তাজিকিস্তানের দুশানবে ও ইরাকের বাগদাদ।
ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম একটা কারণ ধরা হয় আশপাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাকে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার দায় ৫৮ শতাংশ। এর বাইরে রাস্তা ও মাটির ধুলা ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পিএম ২.৫, পিএম ১০, কার্বন মনোক্সাইডসহ ছয়টি দূষণের মাত্রার ভিত্তিতে আইকিউএয়ার তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। বাংলাদেশে পানিদূষণ কিংবা অন্যান্য দূষণ নিয়ে যত কাজ হয়, বায়ুদূষণ নিয়ে ততটা হয় না। কিন্তু বায়ুদূষণের মাত্রাটা খুবই ভয়াবহ। ঢাকার প্রায় শিশুই বায়ুদূষণজনিত রোগে ভুগছে। বয়স্করাও অ্যাজমা-হাঁপানির মতো রোগে ভুগছে। দেশে বায়ুদূষণের বড় কারণ হলো নির্মাণাধীন অবকাঠামো। গাড়ির কালো ধোঁয়াও দায়ী। এগুলো নিয়ন্ত্রণে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’
আপনার মতামত জানানঃ