কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানার তিন এসআইসহ ৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার লুট এবং মুক্তিযোদ্ধাকে মারধরের অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা গ্রামের আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী সালমা আক্তার।
মামলাটি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করে আগামী ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কুমিল্লার পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ২নং আমলি আদালতের বিচারক বেগম মিথিলা জাহান নিপা এ আদেশ দেন।
মামলার বিবাদীরা হলেন, ব্রাহ্মণপাড়া থানার এসআই সাইফুল ইসলাম, জীবন কৃষ্ণ মজুমদার, কামাল হোসেন, এএসআই কৃষ্ণ সরকার, এএসআই মতিউর রহমান, পুলিশ সদস্য নুরুজ্জামান ও জামাল হোসেনসহ অজ্ঞাত আরও ৮-১০ জন। গত ৯ আগস্ট আদালতে মামলাটি হলেও গতকাল আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। এর পরই তোলপাড় শুরু হয় পুলিশসহ বিভিন্ন মহলে।
তবে পুলিশের দাবি, ওই মামলার বাদীর বাড়িতে হত্যা, ডাকাতি ও মাদকসহ ৯ মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ধরতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। সেই ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাজানো অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
আরজি ও সালমা আক্তারের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় বাদীর (সালমা) ভাই লোকমান হোসেনের খোঁজে ব্রাহ্মণপাড়া থানার এসআই সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সাদাপোশাকে একদল পুলিশ চান্দলা গ্রামে তাদের বাড়িতে যায়। এ সময় পরিচয় জানতে চাইলে তারা সবাই ব্রাহ্মণপাড়া থানার পুলিশ বলে দাবি করে। এরপর তারা ঘরে প্রবেশ করে বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি করে। একপর্যায়ে বাদী কোনো মামলার পরোয়ানা আছে কি না, তা জানতে চাইলে তারা গালমন্দ করে লাঠি দিয়ে ঘরের শোকেজের গ্লাস ভেঙে ফেলে। এরপর আলমারির চাবি নিয়ে তল্লাশির নামে ড্রয়ারে থাকা নগদ দুই লাখ টাকা, সোনার দুই জোড়া কানের দুল, দুটি হার ও তিনটি আংটিসহ চার ভরি স্বর্ণালংকার এবং মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় তার (বাদী) চিৎকার শুনে পাশের বাড়িতে থাকা তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা জামাল আহাম্মদ খান ও স্বামী আবুল কালাম আজাদ এগিয়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির বিল্লাল খানের দোকানের সামনে আসেন। তখন পুলিশ সদস্যরা আবুল কালামকে দোকানের সামনে থেকে টেনেহিঁচড়ে আটকের চেষ্টা করেন।
এ সময় বাদীর (সালমা) বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল আহাম্মদ খান পরিচয় দিয়ে বিনা পরোয়ানায় আটকের প্রতিবাদ জানান। তখন এএসআই কৃষ্ণ সরকার তার বাবার মাথায় লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করেন। আঘাতের কারণে জামাল আহাম্মদ খান রক্তাক্ত জখম হন। পুলিশের অন্য সদস্যরা তার স্বামীকেও এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করেন। তারা স্থানীয় লোকজনকে গুলির হুমকি দিয়ে তার স্বামী আবুল কালাম আজাদকে আটক করে নিয়ে যান।
‘পুলিশ আমার বাবা, স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের মারধর করে। তারা আমার ঘরে ডাকাতি করে।’
মামলার বাদী সালমা আক্তার বলেন, ‘পুলিশ আমার বাবা, স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের মারধর করে। তারা আমার ঘরে ডাকাতি করে।’
সালমা অভিযোগ করে বলেন, ‘নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট এবং বিনা অপরাধে মুক্তিযোদ্ধা বাবা ও স্বামীকে মারধরের ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় একটি চক্র জড়িত। তাদের মধ্যে স্থানীয় চান্দলা হাইস্কুল কমিটির সভাপতি বিল্লাল, একই এলাকার ফজলুল হকের ছেলে ডা. বিল্লাল, চান্দলা বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক কনু মেম্বার ও স্থানীয় মোস্তফা মেম্বার রয়েছেন।’
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্রাহ্মণপাড়া থানার ওসি অপ্পেলা রাজু নাহা সাংবাদিকদের জানান, সালমা আক্তারের ভাই হত্যা, ডাকাতি, চুরি, মাদকসহ ৯ মামলার আসামি লোকমান হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এ সময় লোকমান পালিয়ে যায়। পরে সালমার স্বামী আজাদ ও তার সহযোগী মাদক মামলার আসামি ইকবাল হোসেন ও এনামুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। আজাদ নোয়াখালীতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি।
ওসি জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১২ জনকে আসামি করে পরের দিন এসআই সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে সেই মামলায় লোকমান হোসেন, তার সহযোগী ইসহাক খান, হাবিবুর রহমান বাবু, হৃদয় মুন্সীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ওসি অপ্পেলা রাজু নাহার দাবি, পুলিশের করা মামলার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে লোকমানের বোন মিথ্যা অভিযোগে আদালতে মামলা করেছেন।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতার চূড়ান্তে থাকা পুলিশ বাহিনী আসামি ধরার নামে অমানবিক আচরণের কথা নতুন করে জানানোর প্রয়োজন নেই। একজন আসামি ধরতে গেলে পুলিশকে কী কী নিয়মে থাকতে হয় তা থোরাই কেয়ার করে থাকেন। স্থানীয় গুণ্ডা বাহিনীর মতই তাদের আচরণ। বিনা ওয়ারেন্টে আসামি ধরতে যাওয়ার কোনো যুক্তি দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, পুলিশের আচরণ গুণ্ডাদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, মামলার হুমকি দিয়ে টাকা আদায়, আসামিকে অকারণে মারধর, ধর্ষণ, মাদক কারবারি ইত্যাদি নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের।
তারা বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো অপরাধীর মতো আচরণ করতে পারে না। তাদের চাকরিতে প্রবেশের আগে যে প্রশিক্ষণ তা আরও যুগোপযোগী, মানবতা উপযোগী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ উপযোগী হওয়া উচিত।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ