
করোনা মহামারিতে সংক্রমণের হার কমাতে বারবার লকডাউনের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে সরকারকে। এতে সংক্রমণের হারে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য তিন বেলার খাবার জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আয়-উপার্জন হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া মানুষগুলো এখন অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
সূত্র মতে, আমিষের প্রধান উৎস মাছ বা মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন এই শ্রেণির মানুষ। এমনকি অনেকে নিয়মিত ডিমও খেতে পারছে না। কেউ কেউ দিনে মাত্র একবেলা খাচ্ছেন। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বস্তি ও বিভিন্ন পেশার নিম্ন-আয়ের মানুষের অবস্থা এমনই।
৩১শে মার্চ থেকে ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই এবং আগের তুলনায় চরম দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ।
কারওয়ান বাজারে তোয়ালে ও ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা হকার আলম হোসেন জানান, “রাস্তায় জ্যামে পড়া মানুষের কাছে ফুল-তোয়ালে বিক্রি করে দৈনিক ২০০-৩০০ টাকা আয় হতো। লকডাউনে গাড়ি বন্ধ থাকায় আয় নেই। হাতেও কোনো টাকা নেই। কেউ সাহায্যও করছে না। স্ত্রীকে-সন্তান নিয়ে ঠিক মতো একবেলাও এখন পেট ভরে খেতে পারি না।”
তিনি আরও বলেন, “মাংস কেনা তো দূরে থাক, ছেলে-মেয়ের মুখে মাসে একবার মাছও তুলে দিতে পারছি না এখন।”
স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বস্তিতে থাকা মো. মিরাজ বলেন, “তিন বছরের সন্তানকে দুধ কিনে খাওয়াবো সেই টাকা নেই। আলু ভর্তা, ডাল ভাত খেয়ে চলছে দিন। কখনও এক বেলা, কখনও দুই বেলা ভাত খেতে পারছি। করোনার মধ্যে ধার করেছি ৪০ হাজার টাকা।”
বেকার হয়ে পড়া এই নির্মাণ শ্রমিক আরও বলেন, “ছয় মাস আগে একবার মাছ কিনেছিলাম। সরকার থেকে কোন সহায়তা পাচ্ছিনা আমরা। এমন চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।”
রংমিস্ত্রি ইব্রাহিম খলিল বলেন, “করোনার আগে প্রতিদিন কাজ থাকতো। সে সময় সপ্তাহে দুই দিন মাছ, মাসে একদিন গোশত কিনতে পারতাম। এখন শাক, আলু, ডাল দিয়ে ভাত খেয়েই চলে।”
করোনার আগে আরামবাগ গার্লস স্কুলে চাকরি করা রাশেদা আক্তার বর্তমানে শাজাহানপুরের এক রাস্তার পাশে চা-সিগারেটের দোকান দিয়ে কোন রকমে ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে বস্তিতে থাকেন। তিনি বলেন, “আয় খুবই কম। মাছ-মাংস কেনা তো দূরে থাক, ঠিকমত ডিমও কিনতে পারি না। মাঝে মাঝে বাজারে ভাঙ্গা ডিম বিক্রি করে সেইগুলো নেই।”
তিনি আরও বলেন, “১৬ বছর আগে স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। পরিবার আমার একার আয়েই চলে। কোন রকম বেঁচে আছি। দুই মাসের ঘর ভাড়ার ১২০০০ টাকা বাকি পড়েছে। সরকার কোন ধরনের সহযোগিতাও করে নাই।”
শাহাবুদ্দিন গুলিস্তানে মোবাইল এক্সেসরিজের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা চলে না তাই এখন খিলগাঁওয়ে ফল বিক্রি করেন। তিনি বলেন, “কোন রকম খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। কিছু টাকা জমানো ছিল সেগুলো শেষ করে ফেলেছি এই কয় দিনে। সামনে কি হবে কিছুই বুঝতে পারছি না”
কল্যানপুর বস্তিতে থাকা মমতাজ ও তার স্বামী ভ্যানে করে ভাঙ্গারি কিনে বিক্রি করেন। মমতাজ বলেন, “গত এক বছর মাছ কিনি না। সবজি ও ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি।”
মিরপুর-১ এ মুচির কাজ করা অনিল দাশ বলেন, “করোনা আসার পর কাজ নেই হাতে। আমরা দিন আনি দিন খাই। গতকাল জুতা সেলাই করে ৮০ টাকা আয় করেছি, সেই টাকা দিয়ে চাল ডাল কিনেছি।”
তিনি আরও বলেন, “এক বছর আগে দুধ খেয়েছি। সন্তানরা বলেছিল, বাবা, একটু আম দুধ খাব, তাই এক কেজি আম ও দুধ কিনেছি।”
একইভাবে বাসের হেলপার, ড্রাইভার, ভ্যান চালক, হকার, নির্মাণ শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, চা বিক্রেতা সহ বিশাল সংখ্যার নিম্ন আয়ের মানুষ পেট ভরে খেতে পারছেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ