মহামারি করোনার (কোভিড-১৯) প্রথম দুই বছরে বিশ্বে লাখো মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। আর এতে সামষ্টিক জীবন আয়ুষ্কাল প্রায় ৩৩ কোটি ৭০ লাখ বছর কমে গেছে। শুক্রবার (১৯ মে) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আন্তর্জাতিক বার্ষিক পরিসংখ্যান-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ডব্লিউএইচও বলছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত করোনা মহামারির তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হৃদরোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক ব্যাধিতেও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের সরকারি হিসেব অনুযায়ী, করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস সরাসরি এবং পরবর্তীকালে মানুষের শরীরে বড় আকারে প্রভাব ফেলার কারণে কীভাবে লাখো মানুষের আয়ুষ্কাল কমে গেছে, তার ওপর ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে আলোকপাত করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি করোনা মহামারির সময় দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। পরে সেটি ধীরে ধীরে কমে আসে। তবে করোনার কারণে শহরের সমাজে নতুন দারিদ্র্যের আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে ১৮.৭ শতাংশ যে দারিদ্র্য হারের কথা বলা হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক বা ৯ শতাংশের মতো নতুন দরিদ্র হয়েছে। সরকারি হিসেবে দেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। এর ৯ শতাংশ, অর্থাৎ দেড় কোটির বেশি মানুষ মহামারির ধাক্কায় অধোপতিত হয়েছে। নতুন দরিদ্র মানুষকে আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে এই গবেষণার তথ্য প্রকাশ করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আরও উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ও পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিৎ কর্মকার।
সংস্থার মহাপরিচালক বিনায়ক সেন জানান, সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। এর ৯ শতাংশ, অর্থাৎ দেড় কোটির বেশি মানুষ মহামারির ধাক্কায় অধোপতিত হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি না হলে দেশের দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশের আশেপাশে নেমে আসতে পারতো।
বিনায়ক সেন বলেন, মোট দরিদ্রের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন দরিদ্র। যারা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নেমে গেছে। সংকটে থাকা এই শ্রেণির ওপর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, করোনা–পরবর্তী সময় দারিদ্র্য কমাতে আত্মকর্মসংস্থান বড় ভূমিকা রেখেছে। যাদের আর্থিক সঞ্চয় ছিল, তারা সেটি ভেঙে নিজের কর্মসংস্থানের জন্য কাজে লাগিয়েছেন। তা ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে মোবাইলে আর্থিক সেবা বা এমএফএস আত্মীকরণ দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সহায়তা করেছে।
বিআইডিএস প্রধান বলেন, তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, চরম দরিদ্র পরিবারের ২৩.৫ শতাংশ জানিয়েছে, মহামারি চলার সময় তাদের সন্তানদের শিক্ষা বন্ধ করতে হয়েছে। শিক্ষা ও মানবিক পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে শহরের দরিদ্র শ্রেণি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান বিনায়ক। তাদের শিক্ষায় ফেরাতে বিশেষ শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি চালু করারও পরামর্শ দেন তিনি।
বিনায়ক সেন বলেন, ২০১৯ এবং ২০২২ এর মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার ৪.৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। একই সময়ে চরম দরিদ্র পরিবারের অনুপাতও ৩.২ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে গেছে। মহামারির ধাক্কায় অনেক মানুষ আত্মকর্মসংস্থানে ঝুঁকেছে বলেও বিআইডিএস এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে। বিনায়ক সেন বলেন, কোভিডের আগে থেকে যাদের আর্থিক সমস্যা ছিল এবং যাদের কাছে দুঃসময়ের জন্য অর্থ জমা ছিল, তারাই এই সুবিধাটা নিয়েছেন। ওই সময় বেসরকারি এবং সরকারি, দুই পক্ষই নিজস্ব উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থায়ন করেছে। এতে তথ্য প্রযুক্তি এবং কৃষি সম্প্রসারণ প্রযুক্তি কাজে দিয়েছে। ২০২২ সালের শুরুতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে বলে জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
২ হাজার ৪৬টি খানার ওপর জরিপ করে বিআইডিএস এই গবেষণা করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৩.৬০ শতাংশ। করোনার পর অর্থাৎ গত বছর সেটি বেড়ে ৩৮.৫৬ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে করোনার আগে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ১৫.৪৭ শতাংশ। করোনার পর সেটি বেড়ে ৩৩.২১ শতাংশে দাঁড়ায়।
এ ছাড়া ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ এমএফএস ব্যবহার করতো। করোনার পর অর্থাৎ ২০২২ সালে সেটি বেড়ে ৭৮.৭৮ শতাংশ হয়েছে। যদিও তাদের ব্যাংক হিসাব খোলার পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি। করোনার আগে ৩২.২২ শতাংশ পরিবারের ব্যাংক হিসাব ছিল। পরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৩.৭৯ শতাংশ।
অন্যদিকে অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে এমএফএস ব্যবহারের প্রবণতাও বেড়েছে। ২০১৯ সালে এসব পরিবারের মধ্যে ১৫.১৫ শতাংশ এমএফএস ব্যবহার করতো। করোনার পর সেটি বেড়ে ৬৬.৬৭ শতাংশ হয়েছে। এই ধরনের অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ব্যাংক হিসাব খোলার প্রবণতা বাড়েনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পমা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, কোভিডের সময় নানা প্রতিষ্ঠান নানা রকম তথ্য দিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল। তবে বিবিএস এর সর্বশেষ জরিপে যে দারিদ্র্য হার পাওয়া গেল তাতে দেখা যায়, আমরা সঠিক পথেই আছি। তিনি বলেন, সম্পদ যখন সৃষ্টি হয় তখন বৈষম্য অবধারিত। আমি মনে করি, এই বৈষম্য আমাদেরই সৃষ্টি। বৈষম্য প্রশমনে আমরা কাজ করছি। তারই অংশ হিসেবে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার মতো ভাতা দেয়া হচ্ছে। তারা কাজ না করেও ভাতা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, সমতাভিত্তিক সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে বৈষম্য কমানো সম্ভব। আমরা সেটিই করার চেষ্টা করছি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, আমরা যখন জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছিলাম তখনই কোভিড-১৯ এবং পরে ইউক্রেইন রাশিয়া যুদ্ধের আঘাত এলো। দারিদ্র্য বিমোচনে যত প্রকল্প রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়নে মধ্য মেয়াদী পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণের ওপরও জোর দেন তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ