বাড়াবাড়ি রকমের প্রকল্প ব্যয় আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিকারে সংশ্লিষ্টদের কোনো কঠোর পদক্ষেপ না থাকায়, বারবার ঘটছে এই অনিয়ম-দুর্নীতি। এরই ধারাবাহিকতায় এবার খাল থেকে কচুরিপানা অপসারণের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
এদিকে, ঢাকা-ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৬ বার যাতায়াতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ লাখ টাকা। এছাড়াও একটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করতে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়েছে আবার। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিখতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভ্রমণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এই ৫০ লাখ টাকায় মোট ১০ জন প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যাবেন।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় গতকাল বুধবার (২৮ জুলাই) অনুমোদন পাওয়া ‘বিসিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরী, ঠাকুরগাঁও’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন ব্যয় ধরা হয়েছে।
অস্বাভাবিক এ ব্যয়ের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মোশ্তাক হাসান বলেন, এই ব্যয় ডিপিপিতে থাকলেও পরবর্তীতে খরচ না হলে এগুলো আমরা সমন্বয় করে কাজে লাগাবো।
কচুরিপানা কাণ্ড
তবে খাল থেকে কচুরিপানা অপসারণে পাউবোর দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনাও দিতে বলা হয়েছে। পাউবোর হিসাবে ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা পরিষ্কারে প্রতি মিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় হাজার টাকা।
সুবন্দি খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা অপসারণ উল্লেখযোগ্য। এই কচুরিপানা পরিষ্কার করতে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার ব্যয় নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সূত্র মতে, পায়রা নদীর ভাঙনের হাত থেকে বরগুনার আমতলী শহর, আরপাঙ্গাশিয়া ও ঘটখালি বাজার রক্ষায় বাঁধ নির্মাণসহ বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সুবন্দি খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা অপসারণ উল্লেখযোগ্য। এই কচুরিপানা পরিষ্কার করতে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার ব্যয় নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে পরিকল্পনা কমিশন এমন বরাদ্দের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে বলেছে।
এক মিটার কচুরিপানা পরিষ্কারে দেড় হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবসম্মত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব এস এম রেজাউল মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের যারা শিডিউল তৈরি করেছে, তারাই বলতে পারবেন। আমার জানা মতে, উনাদের একটি ব্যাখ্যা আছে। বাপাউবো পুনর্গঠিত ডিপিপি তৈরি করার পর আমি নিজে এটি ভালোভাবে দেখে দেব।’
কচুরিপানা অপসারণে এমন ব্যয়ের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও অনেক অযৌক্তিক ব্যয় ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্দেশনা আমলে নেয় না, কারণ তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। যদি কোনো শাস্তি বা জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে কেন তারা এসব নির্দেশনা আমলে নেবে?
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, কচুরিপানা কি অনেক রকমের হয় নাকি? শুধু কচুরিপানা নয়, আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রেও কাজের তুলনায় ব্যয় কয়েকগুণ বেশি ধরা হয়। এটি অনেক পুরোনো সমস্যা। আগের হাজার হাজার উদাহরণের সঙ্গে নতুন করে বিষয়টি যুক্ত হলো।’
৩৬ লাখের ডিপ টিউবওয়েল
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানায়, তাদের তথ্য অনুযায়ী ঠাকুরগাঁওয়ে সহজেই পানি পাওয়া যায়। অর্থাৎ ওই এলাকায় ডিপ টিউবয়েল স্থাপনের প্রয়োজন নেই। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় ওই এলাকায় শ্যালো টিউবওয়েল দেওয়া হয়। কারণ ৭৫ মিটারের মধ্যে পানি পাওয়া গেলে, শ্যালো টিউবওয়েলই ভালো পানি পাওয়া যায়। কিন্তু এর মধ্যে যদি পানি পাওয়া না যায়, তাহলে ডিপ টিউবওয়েল বসাতে হয়।
সূত্র মতে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় শ্যালো টিউবওয়েল বসাতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা এবং ৪ ইঞ্চি পাইপের ডিপ টিউবওয়েল বসাতে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়।
একটি শিল্প নগরীতে ৩৬ লাখ টাকা দিয়ে ডিপ টিউবওয়ের হয়? ডিপ টিউবওয়েল বসাতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা টাকা লাগে। আমরা যেটা নির্ধারণ করেছি সেটা অনেক আগের হিসেবে করা হচ্ছে।
তবে বিসিক যেহেতু ওখানে শিল্পনগরী করবে সেহেতু অনেক পানির প্রয়োজন হবে। অনেক শিল্প-কারখানা হবে। সে হিসেবে কত ইঞ্চির পাইপ বেষ্টিত ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করবে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে বিসিক চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মোশতাক হাসান বলেন, একটি শিল্প নগরীতে ৩৬ লাখ টাকা দিয়ে ডিপ টিউবওয়ের হয়? ডিপ টিউবওয়েল বসাতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা টাকা লাগে। আমরা যেটা নির্ধারণ করেছি সেটা অনেক আগের হিসেবে করা হচ্ছে। এখন বাস্তবে করতে গেলে আরও বেশি টাকা খরচ হবে। আমার জানা মতে, বর্তমানে ডিপ টিউবওয়েল করতে ৪০ লাখ টাকার বেশি লাগে। আমাদের এ খাতে খরচ কমই আছে বলে আমার মনে হচ্ছে।
আকাশচুম্বী যাতায়াত খরচ
এদিকে, ঢাকা-ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৬ বার যাতায়াতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ লাখ টাকা; এ বিষয়ে মোশতাক হাসান বলেন, এটা হয়তো প্রতিমাসে একবার করে প্রকল্প পরিচালক ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও যাবেন। প্রতি মাসে একবার গেলে তিন বছরে অথবা ৩৬ মাসে ৩৬ বার হয়। এটা সম্ভবত পিডির যাতায়াতের জন্যই ব্যয় করা হবে।
পিডি যদি ঠাকুরগাঁও থাকেন তাহলে প্রতিমাসে আমাদের হেড অফিসে মিটিংয়ে তার আসতে হবে। পিডি এলে ট্রেনে, বাসে নাকি বিমানে আসবেন তার ওপর ব্যয়টা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ডিপিপি দেখলে বিস্তারিত বলতে পারবো। তাছাড়া খাতে টাকা থাকলেই যে খরচ করতে হবে বিষয়টা সেরকম নয়। প্রয়োজনে সংশোধনীতে ব্যয় কমানো হবে।
বিদেশে প্রশিক্ষণ
বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে মোশতাক হাসান বলেন, আমাদের প্রকল্পে সাধারণত বৈদেশিক প্রশিক্ষণ হয় না। আমি এখানে আড়াই বছরে একটি প্রকল্পেও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ পাইনি। এটা হয়তো অন্য কারণে হতে পারে। তাছাড়া যেহেতু খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পনগরী বাংলাদেশে আর নেই, সেজন্যই মনে হয় এটা রাখা হয়েছে। কারণ, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এসব নগরীতে কিভাবে খাদ্য প্রক্রিয়া করে সেটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতেই মনে হয় খাতটি রাখা হয়েছে।
কোন কোন দেশে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ডিপিপি না দেখে বলতে পারবো না। তবে আমার মনে হয় কাছাকাছি হবে। ভারত, থাইল্যান্ড অথবা ইন্দোনেশিয়া হতে পারে।
এ সময় তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকে আমরা যত টাকা নিই, সেগুলো ৫ শতাংশ সুদে আবার ফেরত দেই। যেমন, এই প্রকল্পটি করতে যে ব্যয় হবে সেই টাকা আমরা সুদসহ ফেরত দেবো। এজন্য আমাদের শিল্প নগরীগুলো ক্ষুদ্র শিল্পের পাশাপাশি মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দিচ্ছি। এতে করে পরিবেশের মান বজায় রেখে এবং কৃষি জমির ক্ষতি না করে দেশব্যাপি কলকারখানাগুলো একই প্লাটফর্মে আনা সম্ভব হবে এবং এতে ভালো সাড়া পাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ