সাইফুল বাতেন টিটো : অক্টোবর ২০২০ মাসে কওমি মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও শারিরীক নির্যাতনের মোট ৩৩ টি ঘটনা আমারা জানতে পেরেছি জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকাগুলো থেকে। সেখানে দেখা যায় ১ অক্টোবর ২০২০ থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২০ এই পুরো এক মাসে ৩৩ টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে যার মধ্যে ২৪ টি ছেলে শিশু আর ৯ টি মেয়ে শিশু। একটি শিশুকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়ন চালানো হয়েছে ৭ টি শিশুর উপর। অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে ৬৬ টি শিশুর উপর। সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম আর সিলেট অঞ্চলে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের যে সকল এলাকা থেকে বেশি পরিমান লোক দেশের বাইরে থাকে এবং ধার্মিক ও অপরাধপ্রবন হয় সেইসব এলাকার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগ ও সিলেট বিভাগ উল্লেখযোগ্য।
বিষফোঁড়া বইটি লিখতে গিয়ে আমি শিশু ধর্ষণের অনেকগুলো ধরণ সম্পর্কে জেনেছি। শিশুদের মুখেই শুনেছি। কিন্তু কখনও শুনিনি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কোনো শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। গত ৬ অক্টোবর দেখলাম ঠিক ওরকমই একটি ধর্ষণের সংবাদ। এর মানে হলো শিশু ধর্ষণের নতুন নতুন সিস্টেম আবিস্কার করছে ধর্ষকরা।
২০ অক্টোবর ঘটেছে একটি নির্মম ঘটনা। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় চানাচুর চুরির অভিযোগে মাদ্রাসার সভাপতি ও শিক্ষকরা মিলে ৬০ শিশু শিক্ষার্থীকে মাথা নিচে, পা ওপরে করে আধাঘণ্টা শাস্তি দেন। এতে ২৫ শিক্ষার্থী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারও শুরু হয় বমি, কারও নাক-মুখ দিয়ে বের হতে শুরু করে রক্ত। এ সময় নির্যাতনের শিকার শিশুদের চিৎকারে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে ছুটে এসে মাদ্রাসাটি ঘেরাও করে। ভাবা যায়? পুরো মাদ্রাসার কমিটির লোকেরা থেকে শুরু করে শিক্ষক কারোই মনে হলোনা যে ৬০ শিশুর সাথে ভয়াবহ অন্যায় করা হচ্ছে? এ কোন ধরণের বর্বরতা? এমন শাস্তি দিতে হয়েছে যে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে। অপরাধ কী? শাস্তিদাতারা সন্দেহ করছে ৬০ শিশু মিলে এক প্যাকেট চানাচুর চুরি করে খেয়েছে। এই ঘটনায় নির্যাতিত শিশুদের বাবা মায়ের কানে পানি গেছে। তারা মাদরাসা ঘেরাও করেছে। কারণটা খেয়াল করুন এই ঘটনায় নির্যাতিত শিশুদের অভিবাবক ছিলেন অনেক। ফলে তারা একটা প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু যখন কোনো একটি শিশুর সাথে ঘটনা ঘটে আর সে যখন বিচার চায় তখন সে চারপাশে তাকিয়ে দেখে সে একেবারেই একা। সেই সাথে তার আত্মীয় স্বজন, মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য। ফলে বেশিরভাগ ঘটনাই অজানা থেকে যায়।
২১শে অক্টোবরের একটি সংবাদ আমাকে আলাদা করে ভাবালো। সংবাদের শিরোনামটি হলো ইমামের ছেলেকে মাদরাসা মুহতামিমের বলাৎকার! কী অদ্ভুৎ! আগে শুনতাম কাকের মাংশ কাক খায় না, এখন দেখছি শুধু খায়ই না বেশ মজা করে খায়। জানি না প্রশ্নটি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কিনা, তার পরও করে ফেলি। এই ধর্ষণকারীর কাছে তার নিজের সন্তান কতোখানি নিরাপদ?
২১শে অক্টোবর সহকারী পুলিশ সুপার (রাঙ্গুনিয়া সার্কেল) আনোয়ার হোসেন শামীমের একটি স্টাটাসে আমার চোখ আটকে গেলো। উনি ওনার নিজের আইডি থেকে এবং ভেরিফাইড পেইজ থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এবং সাথে এক ধর্ষক হুজুরের ছবি সাথে উনি নিজে। স্ট্যাটাসে শিরোনাম ছিলো ‘মানবিক বলাৎকারকারী’। ওনার স্ট্যাটাসটা হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘স্যার, ওরা তো খুব ছোট। তাই আমি সবসময় চেষ্টা করি, যেন ওরা বেশি ব্যথা না পায়। আমি তো ওদের শিক্ষক, ওরা ব্যথা পেয়ে কান্নাকাটি করলে আমার খুব কষ্ট লাগে।’ ভাষ্যটি চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসার ৩৫ বছর বয়সী শিক্ষক নাছির উদ্দিনের। নিয়মিত অগণিত শিশুকে তার লালসার শিকারে পরিণত করলেও গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ধর্ষিতদের প্রতি এমনই সদয় তিনি!
নাছিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ফিরিস্তি শুনলে এই মায়াবাক্যকে আপনার কাছে পরিহাসই মনে হবে। মাদ্রাসার হোস্টেলের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে থাকার সুযোগ নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক শিশু ছাত্রকেই নিয়মিত বিছানার সঙ্গী করেন তিনি। ঘটনা সংক্রান্তে প্রাথমিক অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে যা বের হয়ে আসে, তাতে শিউরে উঠবেন যেকোনো বিবেকবান মানুষই।
ধর্ষণ করার জন্য মূলত দশ বছরের নিচে বয়সী ছেলেশিশুদেরকেই টার্গেট করতেন তিনি। কোনো শিশু তার আহ্বানে সাড়া না দিলে তাকে বাধ্য করার জন্য কারণে অকারণে তাকে বেধড়ক মারধর করা হতো। যেহেতু সেখানে বেশিরভাগ শিশুই এতিম/দরিদ্র পরিবার থেকে আসা, শেষপর্যন্ত তার পক্ষে হুজুরের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলা ভিন্ন কোনো উপায় থাকতো না। নাছিরের ছেলেশিশু আসক্তি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে, বিষয়টি টের পেয়ে তার স্ত্রী তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যান।
ধর্ষিত শিশুর প্রতি সহমর্মী হওয়ার পাশাপাশি নাছির আবার ভীষণ রকম নিয়মনিষ্ঠও। বিশৃঙ্খলা তার একদমই নাপছন্দ। তাই তো তিনি একেবারে রুটিন করে দিয়েছেন, ওস্তাদের খেদমতে কবে কখন কোন শিশু হাজির হবে। যেন সেই গল্পের অত্যাচারী সিংহের মতো, যে কি না বনের পশুদের সাথে চুক্তি করেছিল যে, প্রতিদিন একটি করে প্রাণী খাবার হিসেবে তার নিকট চলে আসলে সে আর যারতার ওপর অত্যাচার করবে না। এই করে বেশ ভালো মতোই চলে আসছিল শিক্ষকতার আড়ালে তার বেপরোয়া বিকৃত যৌনজীবন। ছাত্ররাও মারধর, হুমকি-ধামকির ভয়ে নীরবে নিশ্চুপে সব সয়ে যাচ্ছিল।
ঝামেলা শুরু হয় গতকাল সন্ধ্যায়। এক অভিভাবকের কাছ থেকে প্রাথমিক অভিযোগ পাবার পর আমাদের বিশদ অনুসন্ধানে উঠে আসে বলাৎকারী নাছিরের গোপন বিকৃত যৌনজীবনের অবিশ্বাস্য সব খতিয়ান। তারপর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের এবং মধ্যরাতে পরিচালিত আমাদের অভিযানে গ্রেপ্তার ভণ্ড হুজুর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন।
কিন্তু গ্রেপ্তারের পর রীতিমতো ভোল পালটে ফেলেন তিনি। বারবার আমাদের নিকট দাবি করতে থাকেন, তিনি নাকি কাউকে জোর করে বিছানায় নিতেন না, ছাত্ররাই নাকি স্বেচ্ছায় তার সঙ্গ নিতে আসতো। যদিও গরিব ঘরের অসহায় ছেলেগুলোর সাথে দিনের পর দিন কোন কৌশলে, কি কি ঘটিয়েছে নরপশু নাছির, তা আমাদের অজানা ছিল না।
সুখের বিষয় হলো, সকালে আদালতে পাঠানো হলে গ্রেপ্তারকৃত নাছির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত বলাৎকারের অভিযোগ স্বীকার করে নেন। পাশাপাশি বলাৎকারের শিকার শিশুদের মধ্যে চারজনও আদালতে উপস্থিত হয়ে তাদের ওপর চালানো নির্মমতার বর্ণনা দেয়। ইনশাআল্লাহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হবে তার।
অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, আপনার শিশু ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, তার নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় রাখুন। শিক্ষক হোক, আত্মীয় হোক কিংবা হোক প্রতিবেশী, আপনার সন্তানকে কারও অরক্ষিত শিকারে পরিণত হওয়ার সুযোগ দিবেন না প্লিজ।
লেখক: সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি), রাঙ্গুনিয়া সার্কেল, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।
এখানে খেয়াল করুন একজন ধর্ষক কখনও একটি মাদ্রাসায় একটি শিশুকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না। সে এই কাজ সকল শিশুদের সাথেই করতে চেষ্টা করে। সে হয়ে ওঠে একজন সিরিয়াল ধর্ষক। কিন্তু যদি কখনও ধরা পড়ে তবেই আমরা জানতে পারি আর ঐ ঘটনা নিয়ে মেতে উঠি। কিন্তু তার আগে পরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখি না। এএসপি আনোয়ার শামীম নিঃসন্দেহে একজন দায়িত্ববান এবং মেধাবী অফিসার বলতেই হবে। উনি ঠিকই বের করে ফেলেছেন।
এই মাসের সংবাদগুলো বিশ্লেষন করে আমি একটি সংবাদ পেয়েছি যেখানে বড় ছাত্র দ্বারা ছোট ছাত্র ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং ধর্ষণ শেষে ছা্ত্রটিকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে বড় ছাত্র দ্বারা ছোট ছাত্র ধর্ষণের সংবাদ আমার চোখে পড়েনি। তবে ’বিষফোঁড়া’ বইয়ের জন্য আমি যখন সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করছিলাম তখন ছাত্ররা বলেছে মাদ্ররাসায় বড় ছাত্র দ্বারা ছোট ছাত্র ধর্ষণের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি ঘটে, কিন্তু সেটা কখনও বাইরে বের হয় না, কেস মামলা হয় না বলে বাইরের মানুষ জানে না। যদিওবা মাদরাসায় ছাত্রদের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় বা ভিকটিম বিচার চায় তাহলে শিক্ষকেরা ধর্ষককে চড় থাপ্পর দিয়ে বিচার করে। কিন্তু ২৫ অক্টোবরের সংবাদের শিরোনাম খেয়াল করুন ‘রাজধানীতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের পর হত্যার অভিযোগ’। হত্যা করার ফলেই বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। তাও আবার ছেলেটির ডাইরী উদ্ধার করা হয়েছে বলে অনেক তথ্য, যা চাইলেও লুকানো সম্ভব ছিলো না।
২৮ অক্টোবরের একটি সংবাদ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো। প্রথম আলোর সংবাদটিতেও আমার মতো অনেকের চোখ আটকে গেছে জানি। সেখানে একটি ছবিও ছিলো। লো-অ্যাঙ্গেলে তোলা ছবিটিতে দেখা যায় একটি ছোট্ট শিশু টয়লেট বাথরুমের পাইপ বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করছে। আসল ঘটনা হলো মাদরাসার অমানবিক নির্যাতন আর বলাৎকারের ভীতি শিশুটিকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো। কিন্তু কাউকে তো কিছু বলার নাই। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে পাঁচতলা থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নামতে চেয়েছে। শিশুটির বয়স মাত্র দশ বছর। ভাবুন তো একবার নিজের ১০ বছর বয়সী শিশুর মুখটা! আপনার কষ্ট হতে পারে। কিন্তু এদেরে বাবা মায়েদের হয় না। কারণ শফি হুজুর তো বলেই গেছে যে একজন হাফেজ একসাথে ১০ জন লোককে জান্নাতে নিতে পারবে। আর নিজের সন্তান তো তার বাবা মাকে অবশ্যই জান্নাতে নেবে। জান্নাতে যাবার জন্য মানুষ কতো কিছুই তো করে। আল্লার সন্তুষ্টির জন্য নিজের সন্তানকে বলি দেয়ার ইতিহাস তো আজকের না।
সাইফুল বাতেন টিটো, লেখক ও গণমাধ্যম কর্মী
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। State Watch-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই।
আপনার মতামত জানানঃ