মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষাদানে রত মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন একের পর এক অভিযোগ আসছে। কখনো ছাত্র পেটানো, কখনো ধর্ষণ বা হত্যা, কখনো ইয়াবা ক্রিস্টালের মতো ভয়াবহ মাদক ব্যবসার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়া নিয়ে নানা সময়েই খবর আসছে। এতে উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ ও মানবাধিকারকর্মীরা।
রাজধানীর পল্টন এলাকা থেকে কক্সবাজারের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রকে ৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগ।
বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) বিকালে পল্টনের ফকিরাপুলের শতাব্দী সেন্টারের সামনে থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএনসির ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কক্সবাজারের রুমালিয়ারছড়া নুরুল উলিম দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ইলিয়াছ হোসেন (৩৫) ও একই মাদ্রাসার ছাত্র মিজানুর রহমানকে (২২) গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছে থাকে ব্যাগ থেকে ৮ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার দুজন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আনোয়ার হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা তাদের এসব ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছে। বাহক হিসেবে তারা হাজার দশেক টাকা পেতো।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, কক্সবাজারের ইয়াবা কারবারি রোহিঙ্গা নাগরিক জনৈক আনোয়ার মোস্তফার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ২০২০ সাল থেকে ইয়াবা কারবারের সঙ্গে তারা যুক্ত। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের অন্যদের ধরার চেষ্টা ও অনুসন্ধান চলছে।
তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যারটেকে অভিযান চালিয়ে সম্প্রতি ভয়ানক মাদক ক্রিস্টাল মেথ আইসসহ মোহাম্মদ এরশাদ (২৭) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ৫০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস উদ্ধার করা হয়। যার মূল্য অনুমানিক ১ কোটি টাকা।
গ্রেপ্তারকৃত এরশাদ কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার থাইংখালী গ্রামের মৃত সেকান্দর আলীর ছেলে। সে উখিয়ার একটি মক্তবের শিক্ষক বলে জানিয়েছেন পুলিশ।
কর্ণফুলী থানার ওসি দুলাল মাহমুদ বলেন, উপজেলার মইজ্জ্যারটেক মোড়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী পরিবহনে অভিযান পরিচালনা করে এরশাদকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে ৫০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস উদ্ধার করা হয়। যার মূল্য অনুমানিক ১ কোটি টাকা। এছাড়া মাদক ক্রয় বিক্রয় কাজে ব্যবহৃত ১টি মোবাইল এবং ১ সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে।
আটককৃতকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ভয়ানক মাদক ক্রিস্টাল পাচার করছিল।
এর আগে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণিতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বলেন, কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজের কিছু শিক্ষক মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় এসব ব্যক্তি মাদক কেনাবেচাকে পার্টটাইম ব্যবসা হিসেবে মনে করে। সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা রোধ করা একটু কঠিন হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা সতর্ক রয়েছে।
এদিকে দেশে নারীর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের চেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটছে মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা। প্রায় প্রতিদিনই মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক শিশু ধর্ষণের খবর আসে।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ, হত্যা, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হবার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। আজ যারা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, একদিন তারাও শিশু ছিলেন। তাই শিশুদের নিয়ে তাদের রয়েছে নানা ভাবনা। কিন্তু সারাদেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় বহু ছেলেশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছেন কখনো খোদ মাদ্রাসা শিক্ষক তথা মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা।
দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ, হত্যা, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হবার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও ভয়াবহ মাদকের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষকদের জড়িত হবার ঘটনা খবরে আসছে। তবে এসব ঘটনা নিয়ে এক ধরনের নীরবতা লক্ষ করা যাচ্ছে সবার মধ্যেই। কেমন একটা রাখঢাক অবস্থা। কিছু দেখিনি, জানি না, বা কোনো অভিযোগ পাইনি, এমন ভান করছেন সবাই। সরকার খুব বেশি কথা বলছে না। ওদিকে মাদ্রাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ ও শীর্ষস্থানীয় আলেমরা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। উভয় পক্ষ মনে করছে, এ বিষয় নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বললে দেশের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। কিন্তু চুপ থাকা বা নীরবতা সমস্যার সমাধান বয়ে আনবে না। বরং পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ